বিশেষ প্রতিনিধি:
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ঐতিহ্যবাহী খাগাউড়া গ্রামে দোলযাত্রা উপলক্ষে দিনব্যাপী উরিগান অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাধা- বড় না কৃষ্ণ বড়ো, না রাধার সখি বিন্দা বড়ো। রাধার সখিগণের সঙ্গে কৃষ্ণ নিয়ে যে বিতর্ক হয় সেই বিতর্ক বা রাধা কৃষ্ণের লীলা গীতে, সুরে, তালে লয়ে এবং প্রশ্ন- উত্তরের মাধ্যমে দুটি গ্রামের শিল্পীরা দিনব্যাপী পরিবেশন করেছেন। তবে পরিবেশনায় আনন্দের মাত্রা যোগ করতে ঘাটু শিল্পী দিয়ে নৃত্য করা হয়েছে। সূর্যোদয় থেকে শুরু হয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে এই উরি গান। শেষ দুটি পক্ষের মিলন সঙ্গীতের মাধ্যমে শেষ হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই উরিগান। খাগাউড়া গ্রামের আখড়া প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী উরিগান গান উৎসবমুখর পরিবেশে উপভোগ করেছেন হাজারো মানুষ।
খাগাউড়া গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে হাওরাঞ্চলে হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের দোলযাত্রা উপলক্ষে উরিগানের আয়োজন করা হয়। সাধারণত গ্রামের যে বাড়িতে দোলের বেদি প্রতিষ্ঠা করা হয় সে বাড়িতেই উরি গানের আয়োজন করা হয়। উরিগান উপলক্ষে পার্শবর্তী গ্রামের এই গানের শিল্পীদের পান চিনি পাঠিয়ে উরিগান পরিবেশনের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রিত গ্রামের লোকজন উরিগানের শিল্পী নিয়ে এবং দুইজন ঘাটু শিল্পী নিয়ে আগের দিনই নিমন্ত্রিত গ্রামে আতিথ্য নেন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দুটি গ্রামের শিল্পীরা সমান সংখ্যক হয়ে অংশ নেন। গ্রামীণ গীতিকবিরা রাধা ও কৃষ্ণের সখিগণের মধ্যকার সংলাপ নিয়ে গীত রচনা করে দেন। এক পক্ষকে অন্য পক্ষ গীতের মাধ্যমে ঢোল, করতাল, মন্দিরাসহ নানা ধরনের বাদ্য বাজিয়ে প্রশ্ন করেন। অপর পক্ষও একই বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে তাদের গীতিকবিদের রচিত প্রশ্নের উত্তর গীতের মাধ্যমেই দিয়ে থাকেন। এভাবে সারাদিন এক পক্ষ অপর পক্ষকে প্রশ্নবানে জর্জড়িত করে। আর এসব প্রত্যক্ষ করে আনন্দে মাতেন দর্শকরা। এসময় উপস্থিত দর্শকরা হাততালি দিয়ে উভয় পক্ষকে অভিনন্দন জানান। রঙচঙ মেখে ঘাটু শিল্পীরা নেচে গেয়ে আনন্দ আরো বাড়িয়ে তুলেন। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন অন্যান্য সঙ্গীত বা পালার চেয়ে এই উরিগানের আলাদা সুর, তাল লয়ের বিশেষ পার্থক্য আছে।
খাগাউড়া গ্রামের প্রবীণ লোকশিল্পী ও উরিগানের গীতিকবি মুকুল ঠাকুর বলেন, আমি সেই কৈশোর থেকেই উরিগান নিয়ে আছি। ঐতিহ্যের উরিগান দোলযাত্রার আনন্দকে বাড়িয়ে দেয়। এই দিনটির জন্য গ্রামের সবাই সারাবছর অপেক্ষায় থাকেন। এবারও আমাদের গ্রামে প্রতিবেশি জামালগঞ্জ উপজেলার বিনাজুড়া গ্রামের শিল্পীরা এসে উরিগান পরিবেশন করেছেন। তিনি বলেন, গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রেম, ভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও পরস্পরে প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলে উরিগান। রাধাকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিও প্রদর্শিত হয়। তিনি বলেন, উরিগান চলাকালে গ্রামের সববয়সের লোকজন ব্যবধান ভুলে নেচে গেয়ে অংশ নেন।
জামালগঞ্জের বিনাজুড়া গ্রামের শিল্পী নিরদ পুরকায়স্থ বলেন, আমি আমার গ্রামের শিল্পীদের সঙ্গে খাগাউড়া গ্রামে এসে উরিগানে অংশ নিয়েছি। এই গান এমন ঐতিহ্যের গান যা পরিবেশনে কোন একক ব্যক্তি বা শিল্পীকে নিমন্ত্রণ করা যায়না। পুরো গ্রামকে আমন্ত্রণ জানাতে হয়। আমাদের পুরো গ্রামকে খাগাউড়া গ্রামবাসী উরিগানের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর পর আমরা শিল্পীদের নিয়ে গ্রামে এসে দিনভর গান পরিবেশন করেছি। সঙ্গীতের মাধ্যমে ধর্মীয় কাজ সম্পন্নের সঙ্গে সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা করছে এই উরি গান।
উরিগানে খাগাউড়া গ্রামের হয়ে পালায় অংশ নেওয়া মিহির দাস বলেন, রাধা-কৃষ্ণের লীলা, সখিগণের সঙ্গে সংলাপকে কেন্দ্র করেই মূলত উরিগান। গ্রামের মানুষ এই গান খুবই পছন্দ করে। আমাদের গ্রামে এসে এবার বিনাজুড়া গ্রামের লোকজন দিনভর আনন্দ দিয়ে গেছেন। আমরা এই ঐতিহ্য রক্ষা করে চলতে চাই। তিনি বলেন, এক সময় উরিগানের মেয়াদ দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত গড়াতো। পালাকাররা একদলকে না হারানো পর্যন্ত চলতো গান। কিন্তু এখন দুই পক্ষই দিন শেষে মিলনের গান গেয়ে উৎসবের সমাপ্তি করেন। সম্প্রীতির গানে শেষ হয় পালা।