স্টাফ রিপোর্টার::
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তে পাহাড়ি ঢলে ভেসে আসা কোটি টাকার সাদা পাথর মাত্র ১৬ লাখ ২৬ হাজার টাকায় নিলামে বিক্রি হয়েছে—এমন অভিযোগে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, নিলামের মাধ্যমে বড় ধরনের দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাথর পাচার হয়েছে।
জানা গেছে, ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা চানপুর ‘নয়া ছড়া’তে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে বিপুল পরিমাণে চুনাপাথর জমা হয়। এলাকাবাসী ছড়াটিকে ‘সাদাপাথর ছড়া’ হিসেবে চেনেন। এই পাথর নিয়ে গত ২৬ জুন খনিজ ও জ্বালানি সম্পদ বিভাগ একটি নিলাম আহ্বান করে, যেখানে ১৮,৬২৪ ঘনফুট মরাপাথর এবং ২,৮৯০ ঘনফুট চুনাপাথরের কথা বলা হয়।
নিলাম হয় ৮ জুলাই, যেখানে অংশ নেয় ১১৫ জন ব্যবসায়ী। অভিযোগ উঠেছে, এসব ব্যবসায়ী আগেই একটি সিন্ডিকেট করে নিজেদের মধ্যে গোপন দরপত্র আহ্বান করেন। সেখানে বাদাঘাটের ব্যবসায়ী লোকমান আলী ৫২ লাখ টাকা, আর সাইফুল ৪৫ লাখ টাকা দর হাঁকেন। পরে দু’জনেই পাথর নিতে অপারগতা জানালে সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি নেতা সবুজ আলম ৩২ লাখ টাকায় নিলাম নেন। কিন্তু সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে মাত্র ১৬ লাখ ২৬ হাজার টাকা।
নিলামে অংশ নেওয়া কয়েকজন অভিযোগ করেন, ইউএনও’র উপস্থিতিতে অফিসে নিলাম হলেও পরে ‘সিন্ডিকেট বৈঠকে’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথাও ওঠে। সেই সঙ্গে ১১৫ জন অংশগ্রহণকারীকে জনপ্রতি ১৪ হাজার ১৫৬ টাকা করে ভাগ দেওয়ার কথাও শোনা যায়।
শুধু দুর্নীতিই নয়, পাথর পরিবহনের সময় এলাকার একমাত্র সড়কে তৈরি হয় ভয়াবহ শব্দ দূষণ ও যানজট। এতে স্কুল চলাকালীন সময় শিক্ষার্থীদের চলাচল ও শ্রবণ ব্যাহত হয়। ক্ষোভে সোমবার বিক্ষোভে নামে বড়ছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জিনিয়াস চাইল্ড কেয়ার একাডেমি ও দুটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। ফেসবুকে লাইভে এই বিক্ষোভ দেখা গেছে।
এ সময় শিক্ষার্থীদের বাধা দিতে আসেন একজন পাথর ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, “কোটি টাকায় পাথর এনেছি, তোমরা এখন বাধা দিচ্ছো—এটা মানা যায় না।” এতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক প্রধান শিক্ষক জানান, পাথরবাহী যানবাহনের শব্দে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান সম্ভব হয়নি। নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় তারা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছেন। পরে সিদ্ধান্ত হয়, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পাথরবাহী যান চলবে না।
এ বিষয়ে পাথর নিলামে অংশ নেওয়া লোকমান আলী বলেন, “৫২ লাখ টাকায় নিলাম নিয়েছিলাম, কিন্তু টাকা জোগাড় করতে না পারায় নিতে পারিনি।” অন্যদিকে নিলামপ্রাপ্ত সবুজ আলম বলেন, “১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকায় পাথর নিয়েছি। ইউএনওকে টাকা দেওয়ার কথা ভিত্তিহীন। যদি রাস্তা নষ্ট হয়, আমরা মেরামত করব।”
তবে ইউএনও মো. আবুল হাসেম বলেন, “নিলামে কী হয়েছে, তা আমি অফিস কক্ষে যা ঘটেছে সেটুকুই জানি। বাইরে কিছু হয়ে থাকলে আমার জানা নেই।” তিনি আরও জানান, “শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের বিষয়ে শুনেছি, স্কুলঘণ্টায় ট্রাক চলবে না।”
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর উপ-পরিচালক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, “চানপুরের পাথরের নিলাম ১৬ লাখ ২৬ হাজার টাকায় হয়েছে। পরিমাপের পর নিলাম দেওয়া হয়। পরে কেউ পাথর এনে রাখলে তা আমাদের এখতিয়ারে পড়ে না।”
স্থানীয়রা বলছেন, এলাকাটিতে প্রতি বছর কোটি টাকার পাথর জমা হয়, কিন্তু এবার সঠিকভাবে পরিমাপ না করে প্রশাসন তা কম দেখিয়ে নিলাম দিয়েছে। এই ঘটনায় প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন মহল।