তমাল পোদ্দার, ছাতক:
সিলেট পাল্প এন্ড পেপার মিলস্ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুর রব (রব স্যার) আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি বুধবার দিবাগত রাতে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। একজন সাদা মনের মানুষ শিক্ষক আব্দুর রবের জীবনের বেশীরভাগ সময় অতিবাহিত হয়েছে ছাতক শহরে। যার অবাধ বিচরণ ছিলো শহরের অলিতে গলিতে। যিনি প্রায় আশির কোটায় পা রেখেও শিক্ষা বিলিয়ে গেছেন নব উদ্যাম নিয়ে।
আব্দুর রব সিলেট সরকারি পাইলট স্কুল থেকে এসএসসি ও সরকারি এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি, বিএসসি (অর্নাস) সহ চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি (গণিত) পাশ করেন। পড়ালেখার খরচ যোগিয়েছেন বৃত্তির টাকা ও প্রাইভেট পড়িয়ে।
১৯৭৫ সালে সিলেট সদরের রাখালগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় দিয়ে শিক্ষকতা শুরু। ১৯৭৯ সালে তিনি সিলেট পাল্প এন্ড পেপার মিলস্ উচ্চ বিদ্যালয়ে মাত্র ৪’শ টাকা বেতনে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে ডেপুটেশনে ছাতক মহাবিদ্যালয় (ছাতক সরকারি কলেজ) গণিত প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন বিসিআইসি’তে চাকুরী করার সুবাদে তিনি খুলনা কেএনএম হাইস্কুল, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরী হাইস্কুল ও সর্বশেষ সিলেট পাল্প এন্ড পেপার মিলস্ (এস.পি.পি.এম) উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চাকুরী জীবনের ইতি টানেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালে সিলেট পাল্প এন্ড পেপার মিলস বন্ধ হয়ে যায়। ওই কারনে কারখানার সাথে এস.পি.পি.এম উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আশপাশ এলাকায় আর কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় ওই সময় ছেলেমেয়েদের শিক্ষা অর্জনে বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
শিক্ষক আব্দুর রব নিজকে সামলে রাখতে পারলেন না। সংসার ও আর্থিক বিষয়াদি সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে বিদ্যালয়টিকে কিভাবে এমপিও ভুক্ত করা যায় সে জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যান। সকল বাঁধা বিপত্তি উপেক্ষা করে সাবেক সংসদ সদস্য কলিম উদ্দিন আহমদ মিলনের প্রচেষ্ঠায় অবশেষে বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত হয়।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। শিক্ষকতার সকল যোগ্যতা থাকার পরও বি,এড না থাকার কারনে শিক্ষক আব্দুর রব তার হাতে গড়া এমপিও ভুক্ত বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হতে পারেননি।
উল্লেখ্য, ওই সময় বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন বিসিআইসি’র অধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক হতে বি,এড প্রয়োজন ছিলোনা। ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাই শিক্ষকই উচ্চ ডিগ্রিধারী হলেও তাদের বি,এড ডিগ্রি অর্জন করেননি। যার কারনে সকল শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার পরও শিক্ষক আব্দুর রবের বি,এড না থাকার কারনে তার হাতে গড়া এমপিও ভুক্ত বিদ্যালয়ে তিনি প্রধান শিক্ষক হতে পারেননি।
তিনি জীবনে কখনো কারো কাছে মাথা নত করতে শিখেননি। তাইতো এই মহান শিক্ষক জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও মনে অসীম শক্তি নিয়ে ২০০৬ সালে বি,এড পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে উর্ত্তীণ হন। ভেবে ছিলেন এবার বুঝি তাকে বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক করা হবে। কিন্তু তাতেও মন গলাতে পারেননি সমাজের কিছু স্বার্থপর মহলের।
স্কুল ম্যানেজিং কমিটির কারনে তিনি প্রধান শিক্ষক হওয়াতো দূরের কথা ওই সময় বি,এড স্কেল থেকেও বঞ্চিত হন। কর্মক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়ন না পেয়ে হতাশার গ্লানি নিয়ে চাকুরী জীবনের ইতি টানেন শিক্ষক আব্দুর রব।
কিন্তু পিছিয়ে নেই শিক্ষাদানে। প্রায় ৮০ বছর বয়সে এসেও নিয়মিত প্রাইভেট পড়িয়ে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা অর্জনে তার আপ্রাণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে শিক্ষক আব্দুর রব ছেলে মেয়েদের বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়াতেন।
মৃত্যুর আগে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আব্দুর রব জানিয়েছিলেন, এস.পি.পি.এম উচ্চ বিদ্যালয়টিকে এমপিও ভুক্ত করতে গিয়ে অনেক সমস্যা ও বাঁধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। সিলেট পাল্প এন্ড পেপার মিলের তৎকালীন এমডি (ভারপ্রাপ্ত) এস.কে স্যানাল বিদ্যালয়টি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়। তৎকালীন সময়ে বিদ্যালয় বন্ধে সহযোগিতা ও প্রতিষ্ঠান থেকে দায়িত্ব না ছাড়ার কারনে একপর্যায়ে আব্দুর রবের আবাসিক কোয়াটারের পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। পরবর্তীতে তাকে কারখানার বাসা থেকেও বের করে দেয়া হয়। ওই সময় বিদ্যালয়টিকে টিকিয়ে রাখার জন্য এলাকার কোন সুহৃদয় লোকজনের সহায়তাও তিনি পাননি। তার পরও মানসিক দিক দিয়ে ভেঙ্গে না পড়ে মুষ্টিমেয় প্রাক্তন কিছু ছাত্রদের নিয়ে তিনি বিদ্যালয়টিকে এমপিও ভুক্ত করনের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যান।
শিক্ষক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত হতে দেখে শিক্ষক আব্দুর রবের মনের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। আজ হে মহান শিক্ষক পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু এলাকাবাসীর ছেলে মেয়েদের শিক্ষা অর্জনের সুবিধার কথা চিন্তা করে তার নিরলস প্রচেষ্টার দ্বারা বিদ্যালয়টি বন্ধের দারপ্রান্ত থেকে তিনি উদ্ধার করেছিলেন। পরিশেষে প্রবীণ শিক্ষক মরহুম আব্দুর রবের না বলা কথা সমাজে বহিঃপ্রকাশ না ঘটলেও প্রকৃতি তার সাক্ষ্য বহন করতে কৃপণতা করবেনা।