কালের কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হলেও এখনও বলা যায় “যদি ভাটি অঞ্চলে যেতে চাও বর্ষায় ধরো নাও,হেমন্তে বাড়াও পাও”। ভৌগলিক ভাবেই অঞ্চলটি এতো নিম্নে অবস্থান তখন মানুষের ঋতুনির্ভর চিন্তা করতে হয়। বর্ষার পানি সরতেই ভেসে উঠে বড়ো বড়ো জাঙ্গাল, ক্ষেতের আইল, ফুতা( স্তুপ বা টিলা) বিলের পাড়, ভেঙ্গে যাওয়া সড়ক। তখন হালকা সবুজ ছোট ছোট ঘাস বন দিয়ে প্রায় অনাবৃত থাকে। বোর-ধান জমিনগুলোতেও ধান গাছ লাগানো পর্যন্ত তেমন সবুজ দৃশ্য চোখে লাগেনা। কিন্তু ঐ ধান গাছগুলো যখন একটু গোঁছাকারে বড় হয়ে যায় তখন অঞ্চলটা সবুজ রঙ্গে আবিষ্ট হয়। এদের মাঝে ছড়িয়ে ছিঠিয়ে থাকা বিলগুলো চোখে পড়ে। স্থানীয় ভাবে এই বিলগুলোকে মাছের বসবাসের আখড়া বলা যায়। স্থানীয় শ্রুতি আছে বিলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম গভীর বিল হচ্ছে শাল্লার ভান্ডারের বিল। এর অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে গভীরতার জন্য গুন্ডা গুন্ডা রউ(রুই) হয়ে থাকে। এই বিলের রুই মাছগুলো স্বাদে ও গুনে লোভনীয়। বর্ষায় পানি আসলে ঐ সমস্থ বড়ো বড়ো জাঙ্গাল, ক্ষেতের আইল, ফুতা( স্তুপ বা টিলা) বিলের পাড়, ভেঙ্গে যাওয়া সড়ক,বিল ডুবে সমগ্র হাওর একাকার হয়ে যায় । দেখতে এক ও অভিন্ন জলাভুমি মনেহয়। মাঝে মাঝে গ্রাম আর দিগন্তের পরিধি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। নৌকা দিয়ে চলাচল করা যায় একেবারে কোনাকুনি।ঐসময়ে এই অঞ্চলের জীবনযাত্রা আমাদের নাগরিক চোখে নেহাতই অন্য রকম। গোধূলি সন্ধ্যা মনেহয় আবছা নীলাভ রঙের মোলায়েম পরশ হাওরের বুকজুড়ে। নৌকার ছাদে উঠে দাঁড়ালে দৃষ্টিজুড়ে ধরা দেয় সীমাহীন অবাক জলের দুনিয়া! যত দূর চোখ যায়,ঢেউখেলানো নীল জলের রাজ্য। মাঝেমধ্যে সবুজ টিপের মতো জেগে থাকা হিজল-করচের বন। এ সৌন্দর্য ভাষাহীন!
এই সুন্দর শ্রীহীন হয় তখন যখন ঈশ্বান বা সাগর কোনায় স্বাজ সেজে কালো মেঘে ঝড় তোফান ধেঁয়ে ছুঁটে আসে। মনেহয় যেন ইহা সাগর নয় মহাসাগর। ঢেউয়ের উছলানো গর্জনে গলা শুকিয়ে আনে। যারা ভুক্তভোগী তারা জানেন। বর্ষায় উত্তাল হাওয়রে আফালের( দুর্যোগপূর্ন দিন) সময় চাঁন কপালী ঢেউ ( বড় বড় জল তরঙ্গ) তার সকল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অবাধে বিচরন করতে পারে আবার ঠিক শান্ত শিষ্ট পরিবেশে সৌন্দর্য্য বিলিয়ে মহিমান্বিত করে।
মাছের গুন্ডা রুই তার প্রতিবাদী দাপটী মেজাজ দেখিয়ে চষে বেড়ানো ও উছলিয়ে উঠা চাঁন কপালী ঢেউ সমগ্র হাওরের তর্জন গর্জনে প্রতিধ্বনিত করে তুলে। ভাটি অঞ্চলখ্যাত একদিকে যেমন বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনার চাঁন কপালী ঢেউয়ের গর্জন লাগে সিলেট-হবিগঞ্জে অন্যদিকে কুমিল্লা-বিবাড়ীয়ার ঢেউয়ের গর্জন লাগে সুনামগঞ্জে। এই প্রাকৃতিক ঢেউয়ের গর্জনের মতো রাজনীতিতে গর্জন তুলেছিলো হাওরপাড়ের ছেলেরা যেমন হবিগঞ্জের বিপিনচন্দ্র পাল(জন্ম১৮৫৮) থেকে ক্ষুদিরাম সহচর উল্লাসকর দত্ত(জন্ম১৮৮৫), ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত(জন্ম১৮৮৬),মনি সিংহ(জন্ম১৯০১), হেমাঙ্গ বিশ্বাস(১৯১২),কমরেড বরুন রায়(জন্ম১৯২২), সৈয়দ নজরুল ইসলাম (জন্ম১৯২৫)। তাঁদের গর্জন উঠেছিলো ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পাকিস্তান এমনকি বর্তমান রাজনৈতিক থেকে সাংস্কৃতিক সংকটাপন্ন মুভমেন্টগুলোতে। তাদেরই আরেক উত্তরসূরি প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার একান্ত অনুরাগী শ্রীমান মান্যবরেষু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ই মে দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে। তিনি পিতা দেবেন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত ও সুমতি বালা সেনগুপ্তর একমাত্র সন্তান। জন্মের পূর্বে বাবাকে হারালেও জন্মের এগারো বছর পর মা-কে হারান। তিনি দিরাই স্কুল,সিলেটের এমসি কলেজ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সেন্ট্রাল ল’কলেজ থেকে পড়াশুনা করেছেন তাছাড়া দক্ষতা অর্জন করেছেন বাংলা,ইংরেজী, সংস্কৃত ও হিন্দি সহ বিভিন্ন ভাষায় ।
বলা চলে আমাদের দেশে ক্ষমতার রাজনীতিতে নিজেকে নিষ্কলুষ রাখা খুবই দুরূহ। তিনিও বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। তাঁর যেসব বিষয় প্রশংসিত বা নিন্দিত, আমি সেসবের বাইরে একজন মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম রচয়িতা এবং এদেশের সব জাতিসত্তার মানুষের সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য প্রতিবাদী দাপটী মেজাজ দেখিয়ে রাজনীতিতে সমগ্র বাংলায় যে গর্জন তুলেছিলেন তার আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
শৈশবে মুখে ভাষা ফুটে উঠার সময় থেকে তাঁর সাথে স্বাক্ষাৎ হওয়ার আগেই তাঁর নামটি শ্রবনীয়। পরিচিত হয়ে উঠি নির্বাচনী প্রতীক কুঁড়েঘর প্রতীকে। প্রথমতো ১৯৭০ সালের নির্বাচনের হলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালেও তাঁর কুঁড়েঘর প্রতীক ছিল। আমার জন্ম আশির দশকের দিকে । এখানে প্রশ্ন থেকে যায় এতোদিন পর তাঁর এই নির্বাচনী চিহ্ন কিভাবে থেকে যায়? মুক্তিযুদ্ধে সারা ভাটি এলাকার ন্যায় আমাদের গ্রামটিতেও তান্ডব কম হয়নি। স্থানীয় রাজাকার,আল শামস, আলবদর থেকে মুসলিমলীগ বনাম শান্তিবাহিনীর লোকজন আমাদের ঠুনির পালার (বড় গাছের তৈরি খুঁটি) পুরনো দোতলা ঘরটির কোন চিহ্ন রাখেনি। যা রেখেগিয়েছিলো আগুনে ভষ্মীভুত প্যারেক মারা(বড় লোহা)একটি ঠুনির পালা,কয়েক টুকরো ভাঙ্গা-টাঙ্গা ও আগুনে পুরে যাওয়া টিন এবং আমার বাবার মুক্তিকামী দোষের দোষী প্রতিবেশী গুরুদয়ালেগর মামী’র একবাজপত্রী উদ্ভিদ অর্ধ ভষ্মীভুত নারিকেল গাছটি।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এগুলো অনেক দিন ছিলো এখন আর নেই। ঐ যে জন্মযুদ্ধাবশেষে যে কয়টি টিনের টুকরো তাতে আমাদের মূলঘরের বেড়ায় ৭৩ এর নির্বাচনের কুঁড়েঘর প্রতীক আলকাতরার ন্যায় কালো রং দিয়ে ছাপ ছিল। আরো দেখেছি শাল্লার মহাজন বাড়ি খ্যাত ভাটি অঞ্চলের শিক্ষার আলোক বর্তিকা গিরিধর হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা বাবু মহেন্দ্র মাস্টারের দোতলা বিল্ডিং-এ। আজকের ন্যায় তখন মুদ্রণ ছাপাখানার এতো ব্যাপ্তি ছিলনা বিধায় বাড়ি ঘর দেখে দেখে ঘরের বেড়াতে(দেয়াল/ওয়াল) আলকাতরার ন্যায় কালো রং দিয়ে হয়তো ছাপা হতো।
ঐতিহাসিক ভাবে সেনগুপ্তকে যে যেভাবেই পরিচিত করিয়ে তুলক-না কেন দিরাই-শাল্লার কাছে তিনি অতি আপন ও পারিবারিক। তাই পারিবারিক দিকটার আংশিক তুলে ধরা যৎ কিঞ্চিৎ চেষ্টা মাত্র।
ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় কমরেড বারীন দত্ত, অনীল মূখার্জীর মতো মানুষজন ১৯৬৮ সালে সিলেট জেলা সিপিবির সম্মেলন করেন আমাদের বাড়ি আঙ্গারুয়া গ্রামে। ঘরে জায়গা সংকুলান না থাকায় মিটিং বসাতে হয়েছিলো প্বার্শবর্তী আরেক প্রতিবেশী জগৎচন্দ্র দাশের বাড়িতে। বাবা কমরেড শ্রীকান্ত দাশ পার্টির নিবেদিত প্রাণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত হিসেবে বৃহত্তর সিলেট থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত ছিলো এক যোগসূত্র। তাই বাবার সমসাময়িক যে বা যারা জীবিত আছেন দেখা হলে বলে উঠেন “বেটা তোর মা’র হাতের গুরের চা আর হ্বিছা শাঁক যে খাওয়া খাইলাম”।
বাবু মহেন্দ্র মাস্টার বাবার সম্পর্কে কাকা। উনি অত্র অঞ্চলে যেমন ধনাঢ্য ছিলেন তেমনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের (যাত্রা) সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। সেই কারনে সামাজিক,সাংস্কৃতিক,রাজনীতির সব কিছুরই কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বাড়িটিকে গননা করা হয়। ৭০ এর নির্বাচনে উনার বাড়িতেই নির্বাচন পরিকল্পনা করা হয়। উপস্থিত ছিলেন ভাটি অঞ্চলের অনেক মান্যবর সন্তানেরা। আর এই নির্বাচনে সেনগুপ্ত নৌকা প্রতীক ছাড়া জয়ী হয়ে সারা দেশে চমক সৃষ্টি করেছিলেন। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গুন্ডা রুই মাছের ন্যায় দাপটী প্রতিবাদী মেজাজ দেখিয়ে চাঁন কপালী ঢেউয়ের ন্যায় রাজনীতিতে তুলেছিলেন গর্জন। সাধারন মানুষের হৃদয় থেকে জাতির জনকের কর্ন পর্যন্ত পৌঁছে ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের জোয়ারের মধ্যে তিনি মস্কোপন্থী দল হিসেবে পরিচিত ন্যাপ (মোজাফফর)-এর প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঐবছর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান অংশের জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে যারা জীবিত ছিলেন ও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন, তাদের নিয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদ (Constituent Assembly of Bangladesh) গঠন করা হয়েছিল। সেই গণপরিষদের একজন বিরোধী দলীয় সদস্য হিসাবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজেকে আসীন করেছিলেন। তিনি গর্জন তুলেছিলেন ১৯৯২ সালের ২৫শে অক্টোবর নিজামীর নেতৃত্বে ১৬ জন জামাতে এমপি সংসদে ওয়াক আউটকে কেন্দ্র করে। কারন ২২অক্টো: ডানপন্থী পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাবের মাধ্যমে বাজারে রটে গিয়েছিল, ২১ অক্টোবর ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘে’র এক সেমিনারে আহমদ শরীফ বলেন, “ইসলাম টিকে আছে ইতরদের মধ্যে।” এই কথাটাকে উদ্ধৃত করে জামাত উন্মত্তের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল। (একমাত্র ইনকিলাব একটি উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে আহমদ শরীফের এক লাইনের এই বক্তব্যে কোট করে প্রকাশ করে। এর পেছনের উদ্দেশ্য পুরোটাই রাজনৈতিক।)
গর্জন তুলেছিলেন কেয়ারটেকার সরকার বব্যবস্থা বাতিল ব্যবস্থায় পঞ্চদশ সংশোধনে। তাছাড়াও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হমলার পর রক্তাক্ত সুরঞ্জিত ছুটে গিয়েছিলেন সংসদে শোক প্রস্তাব, নিন্দা প্রস্তাব করে প্রতিবাদী গর্জন করতে। যদিও সেদিন সংসদে তাঁকে কথা বলতে দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয় ৭২-এর মূল সংবিধান প্রনয়নে ৪০৪ জন গণপরিষদের সদস্য থেকে একজন মহিলা সহ ৩৪ জনকে দিয়ে প্রনয়ন কমিটি করা হয়। তখনও গর্জন করেছিলেন সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয় নিয়ে। যার ফলশ্রুতিতে তিনি ৭২-এর সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি। কারন তিনি ছিলেন সব জাতিসত্তার মানুষের সাংবিধানিক স্বীকৃতির একজন লড়াকু সৈনিক। একাত্তর বছর বয়সে ২০১৭ সালের আজকের দিনে ( ৫ ফেব্রুয়ারি ) পরলোক গমন করেন। তাঁর এই প্রয়ান দিবসে অতল শ্রদ্ধা।