1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২৩ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

বিদায় ‘বিদ্রোহী ভৃগু’।। উজ্জ্বল মেহেদী

  • আপডেট টাইম :: রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৯, ৭.৫২ এএম
  • ৩৪৪ বার পড়া হয়েছে

‘পাঠে আমার মন বসে না কাঁঠালচাপার গন্ধে…।’ আল মাহমুদের কবিতার এ লাইনের মতোই ছিলাম আমি। পড়াশোনায় মন নেই। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, স্কুলজীবনে আমি ক্লাস পরীক্ষায় বছর বছর পাস করতাম ঠিকই, কিন্তু নম্বর পেতাম না। ‘বে-নম্বরে’ পাস। মূলে ছিল অঙ্ক। আমাকে ‘বিশেষ বিবেচনায় পাস’ করিয়ে দিতেন শিক্ষকেরা অন্য একটি কারণে। সেটি হচ্ছে হাতের লেখা সুন্দর আর বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় বিষয়ে নোটবই না দেখে নিজে নিজে উত্তর তৈরি করায়। হালে সৃজনশীল বলা হয় যাকে।
সব বিষয়ে পাস না করলে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করি কেমনে! এই চিন্তা আমার নিউটেন থেকে শুরু। চিন্তা করে মাথা ঘামাই। তবু অঙ্কের বই-খাতা হাতে নিতে মন চাইতো না। বড় এক ভীতি ছিল। শেষতক, এই ভীতির কাছে হার। সেখান থেকে কিভাবে পাড়ি দিলাম?
এই প্রশ্নসমেত কথা, দুই যুগকাল আগের স্মৃতি, ছবির মতো চোখে ভাসল গত শুক্রবার সকালে মানিক স্যার (মানিক লাল রায়) মারা যাওয়ার খবরে। সুনামগঞ্জ থেকে কৃপেশদার একটি ম্যাসেজ, ‘মানিক স্যার ইজ নো মোর…।’ শোক-কাতরতায় ফেসবুকে চোখ রাখি। জলভরা চোখ হাঁটে। অল্প-কথায় কিছু লিখতে গিয়ে পারছিলাম না। এরপর দুপুরবেলা খলিল রহমানের খুদেবার্তা। আমার সঙ্গে খলিল, আহমেদ জহুরও ছিল মানিক স্যারের ‘ছাত্র’। প্রতিষ্ঠানের বাইরে এই ছাত্রত্ব। তাই কোলনবন্দি করে দেখানো।
আমার কথা দিয়েই শুরু করি। এসএসসিতে তখন পাসের ছড়াছড়ি। আমি ফেল করে বসলাম। ডানে-বায়ে-সামনে-পেছনে সবাই পাস। মুখ দেখানোর জায়গা নেই। সবাই বলছে, মানিক স্যার ছাড়া গতি নেই। একদিন সন্ধ্যাবেলা চুপিচুপি গেলাম। রায়পাড়ায় বসেন মানিক স্যার। সেখানেই চলে তাঁর কোচিংক্লাস। আমি মুখোমুখি দাঁড়াতেই স্যার জানতে চাইলেন, কোন সাবজেক্টে ফেল করেছি। আমি বললাম, অঙ্ক। স্যার বললেন, ‘মার্কশিট দেখা।’ দেখালাম। সিগারেট ধরালেন স্যার। বললেন, ‘চা-খাবি?’ জীবনে প্রথম কোনো স্যারের চায়ের সঙ্গী হচ্ছি। আমি হ্যাঁ-না কিছু বলার আগেই চা এলো। ছোট ছোট কাপ। গরম চা। এক চমুক দিয়ে মানিক স্যার সিগারেট ফুঁকলেন। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আমি। মার্কশিটে চোখ তাঁর। ‘বাংলায় তো তুই সেরা! হাইয়েস্ট মার্ক।’ ফেল করে মহাভারত অশুদ্ধ করা আমি এমন উক্তিতে ভরসা পেলাম। ‘ব্যাপার না। তুই রিগুলার আয়, ফাস্ট ডিভিশন পাইয়ে দিমু!’ এ কথা বলে স্যার আমাকে বিদায় করলেন।
আমি প্রথম যেদিন স্যারের কোচিংয়ে গেলাম, সেদিনই আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটি বই। আউট বই। ‘ইস্পাত’। বইটি পড়ে এক সপ্তাহ পর আসতে বললেন। পড়া হলো ইস্পাত। আমি আবার তাঁর কাছে গেলাম। ইস্পাত নিয়ে গল্প হলো। পাঠচক্রের মতো। তানিয়ার প্রেমে বুঁদ। গল্পসল্প শেষে এবার আরেকটি বই। ম্যাক্সিম গোর্কির মা। তিন দিনে পড়ে যেতে বলেন। আমি তাই করলাম। গেলাম কাছে। বললেন, পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে সুকান্ত কবিতাসমগ্র পড়তে। সমগ্র থেকে সুকান্তের একটি কবিতা বাছাই করে তাঁকে জানাতে। আমি সুকান্তের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার কথা জানাই। স্যার মাথা নাড়ছিলেন, কিন্তু বলছিলেন না কিছুই। এমন অবস্থায় আমি নিজেই প্রশ্ন তুললাম। তাহলে পাঠ্যবই পড়াশোনার কী হবে? শুনে স্যার হাসলেন, বললেন, ‘আসছি, তবে একটু ঘুরে আসতে দে।’ ঘুরতে ঘুরতে টেস্ট পরীক্ষা চলে এলো। স্যার এবার আমাকে পরীক্ষার পড়াতে মনোযোগী। সকাল, বিকেল দুই শিফটে পড়াতেন। মাস শেষে টাকা দিতে চাইতাম, কিন্তু টাকা নিতেন না। বলতেন, ‘রাখ, পাস করলে একলগে দিস।’
এসএসসির টেস্টে আমি যথারীতি অঙ্ক বাদে সব বিষয়ে পাস করলাম। রিজাল্ট মানিক স্যার দেখলেন। কৌশল আঁটলেন। বললেন, ‘অঙ্ক বাদে সব বিষয় পড়া শেষ কর’। এসএসসির রুটিন দিয়েছে। অঙ্ক বাদে সব বিষয় শেষ করেছি। তিন সপ্তাহ আগে মানিক স্যার এবার একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করলেন। অঙ্কের প্রশ্ন। বললেন, ‘বাসায় গিয়ে মুখস্ত করে এসে আমার সামনে বসে উত্তর লিখবি।’ আমি তাই করলাম। সপ্তাহান্তে পরীক্ষা নিলেন। প্রথম পরীক্ষায় ১০০ মার্কে পেলাম মাত্র ০০৩। মানিক স্যার খুশি। বললেন, ‘বাহ, শূন্য থেকে তিন! হবে হবে!’ এবার আরও একটি প্রশ্নপত্র। অর্ধসপ্তাহে পরীক্ষা নিলেন। ০২৭ মার্ক পেলাম। তিনি আমাকে নিয়ে আরও আশাবাদী। তিনটি প্রশ্নপত্র তৈরি করে বললেন, ‘এসএসসিতে এখান থেকেই প্রশ্ন আসতে পারে। সুতরাং তোর লাস্ট চাণ্স। মুখস্ত কর আর পরীক্ষা দে।’ তিন প্রশ্নের উত্তর অঙ্কের সমাধান বই থেকে মুখস্ত করে স্যারের কাছে আরও একটি পরীক্ষা দিলাম। পেলাম পাস মার্ক ৩৩। সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষার তিন দিন আগে নিলেন পরীক্ষা। তাতে পেলাম ৬৩। মানিক স্যার এবার আনন্দিত। গরম চায়ের সঙ্গে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বললেন, ‘লিখে রাখ, তুই ফাস্ট ডিভিশন পাইবে। মন দিয়া পরীক্ষা দিস।’
আমি এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। মনে হচ্ছিল কোনোমতে হয়তো পাস করবো। রিজাল্ট বের হলো। রিজাল্ট শিটের নিচ দিক অর্থ্যাৎ ‘রেফার্ড, থার্ড ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন’ দেখে তাতে আমার রোল না পেয়ে হতাশ। নেই আমার রোল, মানে আবারও ফেল। ফাস্ট ডিভিশনের তালিকার দিকে না তাকিয়ে পালায়ন তৎপর। ঠিক এই সময়ে ওপাশ থেকে একজন সহপাঠী বলল, ‘তুই তো আমারার স্কুলে একমাত্র ফাস্ট ডিভিশন!’ আমি ভাবলেশহীন। ভাবলাম, দ্বিতীয় দফায়ও ফেল করায় উপহাস করছে বুঝি। শেষে আবার চুপিচুপি ফাস্ট ডিভিশনের তালিকায় চোখ রাখি। দেখি জ্বলজ্বল করছে আমার রোল। আমি সবার আগে ছুটে গেলাম, মানিক স্যারের কাছে। কদমবুচি করলাম। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘একটু আগে তোর আব্বা এসেছিলেন। রিজাল্ট শুনে মিস্টি রেখে গেছেন। নে, মিস্টি খা!’ তার মানে মানিক স্যার আমার এসএসসির রোলনম্বর নিয়ে আগেই জেনেছিলেন ফলাফল।
বর্ণনাটা নাতিদীর্ঘ করে দিলাম ইচ্ছে করেই। কেননা, আমার এই বর্ণনার মধ্যে আরও অন্তত শতসহস্রজনের কাহিনি লোক্কায়িত আছে। সহস্রজনের কথা তো বিস্তৃত আকার পাবেই। মানিক স্যারের কোচিংয়ে এমনও দেখেছি যে, সাত-আটবার পরীক্ষা দিয়ে ফেল করা ছাত্ররা তাঁর কাছে গিয়ে দিব্যি এসএসসি পাস করতে। এই কাজটি যদি তিনি চার-পাঁচ দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে করে থাকেন, তাহলে কম করে হলেও লাখো ছাত্রছাত্রীকে তিনি এসএসসি পাস করিয়েছেন। যাঁরা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকদের দিয়ে অগ্রসর হতে পারছিল না। তাঁর কাছে গিয়ে শিক্ষক-সান্নিধ্য যে পরম বন্ধুর, সেটি উপলব্ধীর মধ্যে প্রথম এসেছিল আমার কৈশোর পেরুণো সেই সময়ে।
শিক্ষার একটি মূল্যবান ‘ঘাট’ এসএসসি। এই ঘাটে আটকে গেলে জীবন অন্য রকম হয়। আর পাড়ি দিতে পারলে আর থেমে থাকতে হয় না। আমাকে দিয়ে এই কথাটার আবারও প্রমাণ রাখলেন মানিক স্যার। এসএসসির ঘাট পেরুলেও আমি তাঁর জাদুতে আটকা পড়ি। পাঠ করতে চাই তাঁকে। তিনি প্রাইভেট শিক্ষক। কোচিং করাতেন। বড্ড গণমুখী ছিল তাঁর টিউশন ও শিখন পদ্ধতি। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ার পেছনের কারণটা কি ছিল? এক কথায় বলা যায়, প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কঠিনকে সহজ করে দেওয়া। শুধু যে আটকে পড়া ছাত্ররা ছিল তাঁর কাছে, এমন কিন্ত নয়। এসএসসিতে মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া ছাত্রছাত্রীরা পড়তো তাঁর কাছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সুযোগ পাওয়া ছাত্রও ছিল মানিক স্যারের।
খেয়া পেরুলে আর ঘাট কিংবা মাঝির কথা মনে থাকে কি? থাকে না! মানুষের সহজাত এই অভ্যাসের বাইরে নই আমিও। তাইতো আমিও এক সময় মানিক স্যারের ঘ্রাণ নেওয়া থেকে দূরে চলে যাই। এটাই স্বাভাবিক। যখন নিয়মিত যাতায়াত ছিল, তখন মানিক স্যারকে একবার কৌতূহলী মনে প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলাম, এই যে আপনার হাজার হাজার ছাত্র, এঁদের নাম, পরিবার সবই তো মনে থাকে। কেমনে সম্ভব স্যার?’ এ কথা শুনে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ আছে দূরে গেলে আর মনে থাকে না। আবার কাছে আসলে মনে পড়ে সব। দূরে দুরে থাকতে থাকতে হয়তো ভুলে যাই ছাত্রদের নামধাম।’ আমি সেটি পরীক্ষা করে দেখেছি। স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অনেকদিন ছিলাম। সিলেট চলে আসার পরও যোগাযোগ, দেখাসাক্ষাৎ ছিল না। একদিন একটি ফোন পেলাম। কণ্ঠ শুনেই বুঝলাম, মানিক স্যার। ‘আদাব স্যার’ বলতেই তিনি আশ্চর্য। বললেন, ‘তুই দেখি আমার চেয়ে এক কাঠি বেশি, গলা শুনেই বুঝলি!’
আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন স্যার। আমি ছুটে গিয়েছিলাম। তখন সুরমাতীরে সুরম্য ঠিকানা তাঁর। সুরম্য বলছি এই জন্য যে, এই সুরমা, এই হাওরজল স্যারকে আলোড়িত করেছিল যৌবনে, তারুণ্যে। হয়েছিলেন ‘বিদ্রোহী ভৃগু’। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ব্যালাটে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হতে যুদ্ধ, তাঁর মতে মুক্ত হয়নি কিছুই। তাই মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিতেও আগ্রহী ছিলেন না। ছাত্রজীবনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বিএ পাস করেছিলেন। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে স্বাধীনতার পর প্রথম বিএ পাস ছাত্র ছিলেন তিনি। বিজ্ঞানের ছাত্র। তাই বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্রজীবন থেকেই। রতারগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা নামক চাকরির শেকলে বাধা না পড়া, নিজেই নিজের জগৎ তৈরি করা-এ সবই ছিল অসীম সাহসের। কোচিং করাতেন, কিন্তু টাকার জন্য কোনো টান ছিল না। অথচ অভাব, অর্থ কষ্ট ছিল নিত্যসঙ্গী। তাঁর দশক চারের প্রাইভেট শিক্ষকতা নামের সেবামূলক কাজের ছোট্ট একটি সময়ের সাক্ষী আমি। দেখেছি, দিন-রাত শত শত ছাত্রছাত্রী পড়াচ্ছেন। কিন্তু দিনশেষে বাজার খরচ হাতে নেই। এরপরও কোনো ছাত্র কিংবা ছাত্রীকে বলেননি যে, টাকা দিতে। নিপাট এক নির্মোহ মানুষ। নিজেকে কোনো শাসন-অনুশাসনে বেঁধে রাখতেন না। মনের ভেতর ছিল একটা সুপ্ত ‘জনগণমন’। এই জনগণমনের জন্য মানিক স্যার শুধু পড়াতেন না, রাজনীতিও করতেন। দেশ ও বিদেশের সমসাময়িক বিষয় সচেতন ছিলেন। শ্রেণি-সংগ্রাম, বাম রাজনীতির মূল ধারা, বিপ্লব সংঘটিত করতে আন্ডারগ্রাউণ্ড বা নিষিদ্ধ রাজনীতিতে নিমগ্ন থাকতেন। তখন স্যারকে মাঝে মাঝে আমার কাছে ‘মাস্টারদা সূর্যসেন’ বলে মনে হতো।
ভীষণ তথ্যানুসন্ধানী ছিলেন মানিক স্যার। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় হয়তো তথ্য-তত্ত্ব মাথায় খেলা করতো প্রতিনিয়ত। ধানের ফলনে হাওর এলাকা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, অথচ দেশে আছে খাদ্য ঘাটতি। তা নিয়ে তাঁর একটি সমৃদ্ধ গবেষণা কর্ম আছে। ছাত্র থাকাকালে তাঁর মুখ থেকে শুনে মোহিত হয়েছিলাম। যুক্ত-তর্কে পারদর্শী ছিলেন। যা বিশ্বাস করতেন, তাতে অবিচল থাকতেন। নোয়াতে পারতো না কেউ। প্রচলিত রাজনীতি, ভোটারব্যবস্থায় মোটেও বিশ্বাস ছিল না তাঁর। জীবনে কোনো দিন ভোট দেননি। ‘ভোট দেওয়া নাগরিক অধিকার…’ এমন কথা বলে স্যারের সঙ্গে আমরা তর্কে মাততাম। বলতেন, ‘ভোট দেওয়া যেমন একজন নাগরিকের অধিকার, যোগ্য প্রার্থী না পেলে ভোট না দেওয়াটাও আরেক নাগরিক অধিকার।’
লেখালেখিও করতেন মানিক স্যার। কবিতা লিখতেন। সাংবাদিকতাও করেছেন। সর্বশেষ ‘বিদ্রোহী ভৃগু’ নামে একটি পত্রিকা বের করেছিলেন। সেখানে তাঁর চিন্তা, পূজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদবিরোধী মনোভাব, জাতীয় মুক্তি, আমলা-মুৎসুদ্দি-ফড়িয়া-দালালবিরোধী কথার প্রকাশ ঘটাতেন। গণমানুষের মুক্তির বীজ তিনি রোপন করতে ছাত্রছাত্রী পড়ানো পেশা হলেও ব্যবসা হিসেবে নেননি কখনো। এ জন্য বিরাট একটি তরুণ অনুগামী তৈরি হয়েছিল। কৃষক সংগ্রাম সমিতির মাধ্যমে সাধারণ কৃষকদের দাবিদাওয়া আদায়, ভাসান পানি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হাওরে লুটেরা শ্রেণির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের রাজনৈতিক তৎপরতায় চলমান নির্বাচনী প্রথা না মানা, বারকিশ্রমিকদের ন্যায্য হিস্যা আদায়কে গণদাবিতে রূপ দেওয়ার মধ্য দিয়ে একটি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন তিনি রায়পাড়ায় বসে।
হাওরে ভাসানপানি আন্দোলনের সূতিকাগার কমরেড বরুণ রায়। আশির দশকে এ আন্দোলন ছিল তৃণমূলের শক্তিশালী এক রূপ। ক্ষমতার রাজনীতি, জাতীয় নির্বাচন-এসব কারণে এক সময় ভাটা পড়ে ভাসানপানি আন্দোলন। এই ভাটা থেকে অন্য এক চিন্তাধারায় ‘জোয়ার’ ওঠে ভাসানপানি আন্দোলনে। ‘জাল যার জলা তার’ মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল গহিন হাওরের জেলে-কৃষকদের। আশির দশক পর নব্বই দশক পুরোটা সময় এই আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বড় অবদান ছিল মানিক স্যারের। শেষদিকে এই আন্দোলন এতটাই শক্তিশালী হয়ে ছিল যে, ওই সময় একটি জাতীয় সংবাদপত্র বলেছিল, ‘এ আন্দোলন জাতীয় ইস্যুতেও কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার শক্তি রাখে।’ প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার বাইরে ছিল সবকিছু। তার সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাবরণ জীবন, নির্মোহ মন। হয়তো এই আন্দোলন নিয়ে ভিন্নতর স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল মানিক স্যারের মনে। মত থাকলেই তো দ্বিমত তৈরি হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন নিজের মতে অটল। এক সময় নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন মানিক স্যার। ঠিক এই সময়ে শরীর নামক মহাশয় তাঁকে কাবু করে ফেলে। তবে মন তাঁর সচল ছিল। শরীর-মন বিবেচনায় এ যেন আরেক ভৃগু।
পুরান কাহিনির একটি চরিত্র ভৃগু। কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় এসেছে। কবিতায় নজরুল বলেছেন, ‘আমি/ বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন’। বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা মানিক স্যার বিদায় নিয়েছেন, রেখে গেছেন তাঁর পদ-চিহ্ন। এটি হতে পারে কারো বুকে অথবা ঘুনে ধরা সমাজের শরীরে। তাঁর সংগ্রামী জীবন রীতিমত গবেষণার এক বিষয়। শিক্ষার প্রচলিত ধারায় তিরোহিত ছাত্রছাত্রীদের তিনি তাঁর কাছে নিয়ে আবার ফিরিয়ে দিতেন মূলধারায়। এর মধ্য দিয়ে তো প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষকতা আর অভিজাতের প্রাইভেট টিউশন চ্যালেঞ্জে পড়েছিল। এ অবস্থা মোকাবিলায় একটি মহল থেকে তাঁর সম্পর্কে নানা অপবাদ ছড়ানো হতো। কিন্তু তিনি তা কেয়ার করতেন না।
এই লেখা আবেগতাড়িত মনের। মানিক স্যারের সংগ্রামী জীবনের কয়েকটি পশমের মতো লাগছে। প্রাইভেট টিউশনকে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়ার বীজতলায় তিনি ছিলেন উদার এক আকাশ। তাঁর জনগণমন, গণমুখী শিক্ষা অথবা নিরন্ন মানুষকে নিয়ে প্রধাবিরোধী রাজনীতি-এ সবই সহস্রাব্দের তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণাবস্তু হতে পারে।
হে প্রিয় ‘বিদ্রোহী ভৃগু’! পরলোকের পর আরেকটি ‘কাল’ আছে। পরকাল। সহস্রযোজনের এই কালে বিশ্বাস ছিল না জানি। তাইতো চাইছি, শঙ্খ-চিল-শালিক হয়ে আবার ফিরে আসা। ‘বসতি আবার উঠবে জেগে, জীর্ণ মতবাদ সব ইতিহাস হবে/ পৃথিবী আবার শান্ত হবে…! তখন নিশ্চয় নচিকেতার এ গানের কথা সত্যি হবে।
(লেখকের ফেইসবুক টাইম লাইন থেকে নেওয়া)

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!