1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৮ অপরাহ্ন

বস্তাবন্দি চিনি না গুলিবিদ্ধ জীবন: পাভেল পার্থ

  • আপডেট টাইম :: বৃহস্পতিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৬, ৯.০১ এএম
  • ৫৫৪ বার পড়া হয়েছে

ঐতিহাসিকভাবেই গুড় ও চিনি দেশীয় পণ্য। তাল, খেজুর, গোলপাতা কী আখ থেকে গুড় ও চিনির মত প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য উদ্ভাবিত হয়েছিল এ অঞ্চলেই। ষোড়শ শতকে বাংলার উন্নতমানের চিনি সুপরিচিত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণে চিনি রপ্তানি করত। ১৭৯৫ সালে এ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ২০ হাজার মণ এবং ১৮০৫ সনে ৩৩ লাখ ২৪ হাজার মণ। আগে থেকেই গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ আখঅঞ্চল। ব্রিটিশ আমলে ঐতিহ্যবাহী খেড়ি কুশল, সোম কুশল ও গেন্ডারীর আবাদ হত এখানে। সেই আখ গরু দিয়ে মাড়াই করে তৈরি হত চিনি-গুড়।
আর এই চিনি উৎপাদনের জন্যই গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ৫নং সাপমারা ইউনিয়নের রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নরেঙ্গাবাদ ও চকরহিমপুর মৌজার ১৮৪২.৩০ একর ভূমি ‘রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলের’ জন্য অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয় তৎকালিন পূর্ব-পাকিস্থান সরকার। এলাকাটি সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম নামে পরিচিত। অধিগ্রহণের ফলে ১৫টি আদিবাসী গ্রাম ও ৫টি বাঙালি গ্রাম উচ্ছেদ হয়। কথা ছিল অধিগ্রহণের নামে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেয়া এই জমিনে আখ চাষ হবে। আখ ভিন্ন অন্য কোনো ফসল চাষ করা হলে বা চিনিকলের উদ্দেশ্যর সাথে সম্পর্কহীন কোনোকিছু করা হলে কেড়ে নেয়া এসব জমি আবারো ভূমিমালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হবে। চিনিকল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অব্যস্থাপনার দরুণ ৩১ মার্চ ২০০৪ সালে  কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। চিনিকল কর্তৃপক্ষ নানাভাবে অধিগ্রহণকৃত জমি বহিরাগত প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিতে শুরু করে। জন্মমাটি থেকে উদ্বাস্তু আদিবাসী ও বাঙালিরা পুরো ঘটনাটি প্রশাসনের নজরে আনে। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সনের ৩০ মার্চ গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এলাকা সরেজমিন তদন্ত করেন। তদন্তকালে তারা উল্লিখিত জমিতে ধান, তামাক ও মিষ্টিকুমড়ার আবাদ দেখতে পান। এরই ভেতর গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন ১০ মে ২০১৬ তারিখে উক্ত ভূমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন সরকার বরাবর। বাপ-দাদার জমিনে অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবিতে আদিবাসী-বাঙালি ভূমিহীনদের তৈরি হয়েছে ভূমি আন্দোলন। আন্দোলন দমাতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও গাইবান্ধা প্রশাসন ভূমিহীনদের সংগ্রামে খুন-জখম-হামলা-মামলার বাহাদুরি চালিয়ে যাচ্ছে।
অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয়া জমিনে ভূমিউদ্বাস্তু প্রায় ৪০০০ পরিবার মাদারপুর মৌজার কুয়ামারা পুকুরের উত্তর ও দক্ষিণে এবং নরেঙ্গাবাদ মৌজার বাছুরমারী পুকুরের উত্তর-পশ্চিমপাড়ে ছাপড়া ঘর তুলে বসবাস শুরু করে। সাঁওতালরা তাদের মানঝিথান তৈরি করেছে, বাঙালি মুসলিমরা মসজিদ ঘর তুলেছে, জমিনে খেসারীকলাইসহ শস্য ফসল বুনেছে। ২০১৬ সনের ১ জুলাই চিনিকল কর্তৃপক্ষ, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা পাঁচটি মৌজায় পরিদর্শন করে নিজেদের জমিনে নতুনভাবে বসতিস্থাপনকারী ভূমিমালিকদের ঘরবাড়ি তুলে চলে যাওয়ার কথা বলেন। ২০১৬ সনের ১২ জুলাই মিল কর্তৃপক্ষ পুলিশ ও লাঠিয়াল বাহিনি নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশের গুলিতে বেলোয়া গ্রামের মাঝি হেমব্রম, বুলাকিপুর গ্রামের মাইকেল মার্ডি, গুচ্ছগ্রামের সোবান মুরমু ও বেলোয়া গ্রামের মুংলী টুডু চারজন গুলিবিদ্ধ হয় এবং অনেকেই আহত হয়।  তারপর তো এই ৬ নভেম্বরের ভয়ংকর মর্মস্পর্শী ঘটনা। গণমাধ্যমে ছবি এসেছে পুলিশ নিরীহ আদিবাসী গ্রামের দিকে বাহিনীসমেত বন্দুক তাক করে আছে। আগুন দেয়া হচ্ছে ছাপড়া ঘরে, পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।
২০১৬ সনের ৬ নভেম্বর রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকল কর্তৃপক্ষ তাদের শ্রমিক-কর্মচারী ও ভাড়াটে মাস্তান বাহিনী নিয়ে হামলা চালায় গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউনিয়নের মাদারপুর গ্রামের নিরীহ আদিবাসী ও বাঙালিদের উপর। চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের ভাষ্য তারা জমি থেকে বীজ-আখ কাটতে সেখানে গিয়ে ‘অবৈধ দখলদারদের’ উচ্ছেদ করেছে। পুলিশ ও চিনিকলের আক্রমণে নিহত মঙ্গল মার্ডী (৫০) এবং শ্যামল হেমব্রমের (৩৫) লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশ মঙ্গল মার্ডীর লাশ নিয়ে গেছে। মুংলী সরেন ও রুবেন সরেন নামে দুই সাঁওতাল প্রবীণকে ঘটনার পর থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হামলায় মারাত্মকভাবে জখমপ্রাপ্ত দিজেন টুডু ঢাকায় চক্ষু হাসপাতালে এবং চরণ সরেন ও বিমল কিসকু রংপুর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন আছেন। মাঝি হেমব্রমকে এ পর্যন্ত দুই বার গ্রেফতার করা হয়েছে।
চিনি উৎপাদনের জন্য রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকল দীর্ঘ ৫৬ বছর ধরে স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালিদের জমি কেড়ে তাদের সাথে অন্যায় আচরণ করে চলেছে। অথচ চিনি উৎপাদনের জন্য মিল কর্তৃপক্ষ কী রাষ্ট্র কখনোই আন্তরিক ছিল না। তাই বারবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কারখানা। ২০০৪ সনে বন্ধের পর ২০০৬ সনের ১৬ জুলাই মিলটি পুনরায় চালু করার নির্দেশ দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ২০০৭-২০০৮ মওসুমে ৩৩ দিন চালু থাকে এবং ৫,৩২৫ টন চিনি উৎপাদিত হয়। ২০১৩-২০১৪ মওসুমে ৫,২৬৮ এবং ২০১৪-২০১৫ মওসুমে ২,৪৪০ টন চিনি উৎপাদিত হয়। বছরে ১৫ থেকে ৪৫ দিন কারখানা চালু থাকে। ২০১২-২০১৩ মৌসুমের ৫৬ তম আখ মাড়াই কার্যক্রম উদ্বোধনের পর মাত্র ১০ ঘন্টা পরেই বন্ধ হয়ে যায় চিনিকলের কার্যক্রম। রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকলে প্রচুর চিনি অবিক্রিত থেকে যায়। ২০১৩ সনে তিনহাজার ২৪৬ মেট্রিক টন চিনি বস্তাবন্দী হয়ে দুই বছর ধরে গুদামে পড়ে গলে গেছে। রংপুর চিনিকল আখচাষি কল্যাণ গ্রুপের সভাপতি তখন গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছিলেন, চিনিশিল্প সংস্থার ভুল নীতির কারণে এত চিনি অবিক্রিত থেকে যায়। একটি হিসাবে দেখা যায় তিন বছরে প্রায় ৩১ কোটি টাকার চিনি অবিক্রিত ছিল। শুধু তাই নয়, মিল কর্তৃপক্ষ শ্রমিক কর্মচারীদের ঠিকমত বেতন ভাতা দিতেও সমস্যা করে। চিনিকলে র্করত প্রায় ৮১২ জন শ্রমিক তিন মাসের বকেয়া বেতন ভাতা, বোনাস ও পোষণ ভাতার দাবিতে ২০১৫ সনের ১২ জুলাই মিল চত্বরে বিক্ষোভ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে।
বর্তমান সরকার বলছে, তারা চিনিশিল্প রক্ষায় দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ। আসলেই কী তাই? রংপুর চিনিকলের বাস্তবতায় আমরা কী দেখি? সেখানে তো নিয়মমত আখই চাষ করা হয়নি, জুমিন সব লুটপাট হয়ে গেছে। আখ উৎপাদনে রাষ্ট্র কখনোই আন্তরিক ছিল না, রংপুর চিনিকলও চিনি উৎপাদনে তৎপর ছিল না। এটি ভূমিউদ্বাস্তু কৃষক বা আন্দোলনকারীদের বক্তব্য নয়। এটি সরকারি প্রতিবেদনেরই ভাষ্য। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরো খোলাসা হয়। ২০১১-২০১২ সনে রংপুর চিনিকলের জন্য চাষীর জমিতে আখচাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় ৮০০০ একর এবং খামারের জমিতে শূণ্য। চাষীর জমিতে আখ চাষ করে ঐ বছর ৩,৯৫৭ একর জমিতে আখ চাষের প্রকৃত অর্জন হয়। দেখা যায় একই অর্থবছরে ইক্ষু মাড়াই লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয় ৭০,০০০ মে.টন কিন্তু অর্জিত হয় ৪০.৯৪ মে.টন। চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয় ১৫,০০০ মে.টন কিন্তু অর্জিত হয় মাত্র ১০.০৭ মে.টন। আরেকটি বিষয়ও স্পষ্ট করা জরুরি চিনিকলের এই আখ কতটা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর উপায়ে চাষ করা হচ্ছে। হাতে গোণা কিছু আখ চাষ হলেও তার পুরোটাই রাসায়নিক বিষ নির্ভর। এভাবে চাষ হওয়া আখ থেকে তৈরি চিনি আমরা সরাসরি খাই, চিনি তো আর কেউ ধুয়ে খায় না। পূর্বে উল্লিখিত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০১১-২০১২ সনে আখ চাষের জন্য ১০০০ কেজি কার্বোফুরান, ৬৩০ কেজি ক্লোরপাইরিফস এবং ৬৭৮ কেজি কার্বোডাজিমের মতো ভয়াবহ রাসায়নিক বিষ ব্যভহারের লক্ষ্যমাত্রা দায্য করা হয়। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সন পর্যন্ত চিনিকল কর্তৃপক্ষ টেন্ডার নোটিশ দিয়ে আখ চাষ করাত, তখন আশেপাশের অনেক ভূমিউদ্বাস্তু মানুষও অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয়া নিজেদের জমিতে আখ চাষ করতো। তখন দৈনিক মজুরি ছিল দেড় টাকা। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষ যখন আখের জমি ইজারা দেয়া শুরু করে তখন এভাবে আখ আবাদ বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে দেকা যায় রংপুর(মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলে যা চলছে এই পুরো প্রক্রিয়াটিই দেশের রাজস্ব ও শিল্পখাতকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। বরং সরকার ও আইন সম্পর্কে ভূমিবঞ্চিত হাজার হাজার মানুষের মনে একধরণের বঞ্চনা ও ক্ষোভ জমা হচ্ছে দিনের পর দিন।
চিনিকল ও পুলিশি হামলায় চুরমার হয়ে যাওয়া মাদারপুর মৌজার আদিবাসী ও বাঙালিরা এখন নি:স্ব ও নিরন্ন। ঘর নেই, খাবার নেই, খাবারের কোনো সংস্থানও নেই। দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকারখানাগুলোতে দিনের পর দিন চিনি বস্তাবন্দি হয়ে পচে গলে যায়। সেখানে প্রশাসন কী জনপ্রতিনিধিরা নিশ্চুপ থাকে। আর আজ আখচাষের মিথ্যা সাফাই দিয়ে জমি লিজ ও সাবলিজের বাণিজ্যকে চাঙ্গা রাখতে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মে প্রশ্নহীনভাবে একের পর এক আদিবাসীদের খুন-জখম-উচ্ছেদ করা হচ্ছে। মানুষের জীবনের দামে আমরা কোনোভাবেই সাদা সাদা দানাদার মিষ্টি চিনি চাই না।
………………………………………………………………..
গবেষক ও লেখক। animistbangla@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!