অনলাইন ডেক্স::
নিম্ন আয়ের দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’য় পড়েছে বাংলাদেশ। নিম্ন আয়ের দেশে থাকাকালে উন্নত বিশ্ব ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যেত, সেগুলো দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে বাংলাদেশের জন্য। বিশ্বব্যাংকসহ বহুজাতিক সংস্থাগুলোর পর এবার জাতিসংঘ বাংলাদেশের জন্য তাদের সহায়তা কমিয়ে ফেলছে। দরিদ্র দেশ হওয়ায় আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে জাতিসংঘের কাছ থেকে এত বছর যে পরিমাণ অনুদান পাওয়া যেত, সেটি ৩৩ শতাংশ কমিয়ে ফেলেছে জাতিসংঘ। এমন তথ্য মিলেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে।
ইআরডি সূত্র বলছে, উন্নয়ন সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় আগামী চার বছরে (২০১৭-২০) বাংলাদেশকে ১২২ কোটি ডলার অনুদান দেবে জাতিসংঘ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। অথচ এর আগের মেয়াদে অর্থাৎ (২০১২-১৬) ১৮০ কোটি ডলার অনুদান সহায়তা দিয়েছিল জাতিসংঘ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকা। টাকার অঙ্কে অনুদানের পরিমাণ কমছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। অনুদানের পরিমাণ কমানোর বিষয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ এখন আর আগের অবস্থানে নেই। এখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। দেশের অর্থনীতিও একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। এমন বাস্তবতায় জাতিসংঘের মনোযোগ এখন আফ্রিকার দেশগুলোতে। তাই বাংলাদেশে তাদের অনুদানের পরিমাণ কমানো হচ্ছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর শেরে বাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সরকার ও জাতিসংঘের মধ্যে নতুন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট সই হওয়ার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু দেশ জাপান ঋণের সুদের হার বাড়াতে যাচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকে এরই মধ্যে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, নতুন করে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাচ্ছে না। বৈশ্বিক সংস্থাগুলো ব্র্যাকে অনুদানের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, সামনের দিনগুলোতে আর সহজ শর্তের ঋণ মিলবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ফলে ভবিষ্যতে সহজ শর্তে ঋণের পরিমাণ কমে যাবে। ঋণ নিতে হলে সেটি কঠিন শর্তের ঋণ নিতে হবে। তাই অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের হার বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। একই সঙ্গে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ানো ও পণ্য বৈচিত্র্যকরণের ওপর জোর দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের হার বাড়ানোর মাধ্যমেই আমরা পরনির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠব।’ এনবিআর সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই রাজস্ব আদায়ের হার বাড়ছে। মানুষকে আমরা রাজস্ব দিতে উদ্বুদ্ধ করছি।’ তবে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক বিশ্বের যে দায়িত্ব রয়েছে, সহজ শর্তে ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ এখনই কমিয়ে দিলে তারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে বলেও মনে করেন তিনি।
ইআরডি সূত্র বলেছে, জাতিসংঘের অধীনে থাকা বড় সংস্থাগুলো এবার তাদের অনুদান সহায়তা কমিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) এবং এফএও। জাতিসংঘের অধীন ২২টি সংস্থা বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে কাজ করে। এর মধ্যে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি কাজ করে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থ-সামাজিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নে। ইউএনএফপিএ কাজ করে দেশের জনসংখ্যা নিয়ে। ইউনিসেফ কাজ করে শিশু ও পুষ্টি বিষয়ে। এভাবে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, শ্রম সংস্থাসহ ২২টি সংস্থা একেক খাত নিয়ে কাজ করে। নিয়মানুযায়ী, সব সংস্থা মিলে জাতিসংঘের আওতায় সরকারের সঙ্গে একটি ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট করে। তবে সব সংস্থার আলাদা আলাদা কর্মকৌশল রয়েছে এবং আলাদা আলাদা অনুদান ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে। ২০১২ থেকে ২০১৬—এ সময়ে ইউএনডিপি বাংলাদেশকে ৫৫ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছিল। তবে নতুন ফ্রেমওয়ার্কে (২০১৬-২০) সংস্থাটি ৩১ কোটি ডলার অনুদান দেবে। সে হিসাবে সংস্থাটির অনুদান কমেছে ২৪ কোটি ডলার। আগের ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছিল ইউনিসেফ। নতুন ফ্রেমওয়ার্কে সংস্থাটি অনুদান কমিয়ে ৩৪ কোটি ডলার করেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি আগের কর্মসূচিতে বাংলাদেশকে ৩২ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছিল। সেটি এখন কমে ২০ কোটি ডলারে ঠেকেছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আগের মেয়াদে যেখানে অনুদান দিয়েছিল ১০ কোটি ডলার। সেটি এবার কমে ৪৫ লাখে নেমে এসেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতিসংঘের এসব সংস্থা ভবিষ্যতে আফ্রিকার দেশগুলোতে তাদের অর্থায়ন বাড়াতে চায়। সে জন্য বাংলাদেশ থেকে অনুদানের পরিমাণ কমিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজিতে অসাধারণ সফলতা দেখিয়েছে।
ঢাকায় জাতিসংঘের সূত্র বলেছে, আগামী ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের যে স্বপ্ন দেখছে সরকার, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মকৌশল ঠিক করেছে জাতিসংঘ। সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যেসব খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, জাতিসংঘ তাদের ফ্রেমওয়ার্কে সেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, সামনের দিনগুলোতে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্য। তাই এখন থেকে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বাড়ানো, পণ্যবৈচিত্র্য আনা এবং রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ানোর ওপর জোর দিতে বলেন তিনি।