1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৬:৪৫ অপরাহ্ন

কাউয়ায় ধান খাইলরে, খেদানির মানুষ নাই…: গান প্রসঙ্গে কিছু কথা।। ড. জহিরুল হক শাকিল

  • আপডেট টাইম :: বৃহস্পতিবার, ৮ জুলাই, ২০২১, ৬.৪৯ পিএম
  • ৪৩৯ বার পড়া হয়েছে

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি আর স্বাধীন বাংলাদেশে দূর্নীতিবাজ,রাষ্ট্রীয় ও গরীবের সম্পদ আত্মসাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যাওয়া ও স্বৈরাচার এবং মৌলবাদ বিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত হচ্ছে প্রতিবাদের ভাষা। আর এসব গণসঙ্গীত নিয়ে সিলেট বিভাগের গন্ডি পেরিয়ে সারা দেশে যাদের বিচরণ ছিল তাদের একজন হলেন কমরেড শ্রীকান্ত দাশ। গত ৫-জুলাই নিরভ নিভৃতে চলে গেলো কমরেড শ্রীকান্ত দাশের ৯৭তম জন্মদিন। ১৯২৪ সালের এ দিনে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার প্রত্যন্ত আঙ্গারুয়া গ্রামে তাঁর জন্ম।

কয়েকমাস পূর্বে শাল্লার নোয়াগাওয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা পরবর্তী ক্ষত দেখতে ও নির্যাতিতদের প্রতি সংহতি জানাতে ‘দুঃষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’র ব্যানারে গিয়েছিলাম সেই প্রত্যন্ত এলাকায়। ঘটণাস্থলের ৪ কিলোমিটারের মধ্যে আঙ্গারুয়া গ্রামে কমরেড শ্রীকান্ত দাশের জন্মভিটা। তাই আমরা পুরো টিম সেখানে যাই। আঙ্গারুয়া গ্রামের এই ঘরটিতে বাংলাদেশ ও ভারতের শত শত কমরেডের পদচারনা হয়েছে। প্রত্যন্ত ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তিন আমলেই শ্রীকান্ত দাশের এ বাড়িটি ছিল রাজনীতিবিদ, কর্মী ও সংগঠকদের জেল জুলুম হুলিয়া থেকে বাচঁতে আত্মগোপনে যাওয়ার নিরাপদ ভূমি। কমরেডের জীবদ্দশায় কত শত রাজনীতিবিদ ও কমরেড এ বাড়িটিতে এসেছেন তার গল্প করছিলেন ৮০ বছর বয়স্ক কমরেড শ্রীকান্ত দাশের স্ত্রী ছায়া রাণী দাশ। মৌলভীবাজারের ঘাগটিয়া গ্রামের ধনাঢ্য প্রভাত তালুকদারের কন্যা ছায়া রাণী তালুকদার কমরেডকে বিয়ে করে হয়ে যান ছায়া রাণী দাশ। জানালেন তাঁর জীবনের ত্যাগ তিথিক্ষার কথা। বিয়ের পর থেকেই বেশির ভাগ সময়ই তাঁর স্বামী কমরেডকে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। বাড়ীতে থাকলেও কমরেডদের আনাগোনা। তাদের জন্য রান্না বান্না। থাকার জায়গার সংস্থান করা। পুলিশি তল্লাশী ও তাদের জীজ্ঞাসাবাদের জবাব দেয়া। অজানা স্থান থেকে স্বামী কমরেডের চিঠি। ৭ সন্তানকে মানুষ করার জীবন সংগ্রাম। আজ থেকে এক যুগ পূর্বে কমরেডের এ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া। তাঁর মরণোত্তর দেহ ওসমানী মেডিক্যালে দান করা। ৭ সন্তান তথা আল্পনা তালুকদার (৬০ বছর), দুরন্ত দাশ (৫৮ বছর), জল্পনা রাণী সরকার (৫৫বছর), কল্পনা রাণী তালুকদার (৫২ বছর), সুকান্ত দাশ (৫০ বছর), কবিতা রাণী দাশ (৪২ বছর), সুশান্ত দাশ (৪০ বছর) এর বেড়ে ওঠা। এসব নিয়ে আজ ৮০ তে পা রাখছেন কমরেড পত্নী ছায়া রাণী দাশ। জীবন সয়াহ্নে অনেক গল্প শুনালেন। ৭ সন্তানের মধ্য কনিষ্ঠ সন্তান সুশান্ত দাশ (অনেকে তাকে প্রশান্ত দাশ নামে জানে) ও আমি লন্ডনে খুবই ক্লোজ ছিলাম। সেই সুবাদে তার মুখ থেকে তার বাবার অনেক গল্প শুনেছি। দেশে ফিরে আসলে প্রশান্ত বার বার আমাকে ফোন দিয়ে বলতো তাঁর মা অর্থাৎ কাকিমাকে দেখে আসতে। দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকা হওয়া যাওয়া হয়ে উঠেনি। নোয়াগাও পরিদর্শনের পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিংকনকে নিয়ে যাই কমরেড শ্রীকান্ত দাশের স্মৃতি বিজরিত জন্মভিটায়। সাথে ছিলেন এনামুল মুনির ভাই, মুক্তাদির আহমেদ মুক্তা ভাই, পরিবেশ আন্দোলনের নেতা আব্দুল করিম কিম ভাই, তোফাজ্জল সোহেল ভাই, গণজাগরণ মঞ্চের দেবাশিস দেবু, কমরেড নিরঞ্জন, রুবেল মিয়া। কমরেড শ্রীকান্তের শয়ন কক্ষে তথা যে বিছানায় ঘুমাতেন ঠিক তার পাশেই কার্ল মার্কস ও লেনিনের ছবি সাটানো আছে। রয়েছে ডাস ক্যাপিটালও । একটি প্রত্যন্ত ও সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় জন্ম নিয়ে এই ব্যক্তি কীভাবে এতোটা দৃঢ়তার সাথে সাম্যবাদী ধ্যান ধারনা আঁকড়ে ছিলেন তা অবিশ্বাস্য। সমাজতন্ত্রের মন্ত্র নিয়ে আজীবন সংগ্রামী প্রবীণ রাজনিতিক, মুক্তিযুদ্ধা, গণসংগীত শিল্পী কমরেড শ্রীকান্ত দাশের জন্মদিনে তাকে নিয়ে কয়েকটি লাইন তুলে ধরছিঃ

কমরেড করুনাসিন্ধু রায়ের (কমরেড বরুন রায়ের বাবা) হাত ধরে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে আসা শ্রীকান্ত দাশ ১৯৪৩ সালে সুরমা উপত্যাকায় ৮ম কৃষক সম্মেলন, পরে হবিগঞ্জের বাল্লা জগন্নাথপুরে এক মাস ব্যাপী গণসংগীত ও পথসভায় নেতৃত্বদান, ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অল ইন্ডিয়া কৃষক সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে সঙ্গীত, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মাধ্যমে গণমানুষের দাবী আদায়ের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির পর পাকিস্তান শাসন-শোষণ বিরোধী আন্দোলনে ভাটি অঞ্চল কাঁপিয়েছেন কমরেড শ্রীকান্ত দাশরা। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ আর এর মধ্যবর্তী সকল আন্দোলন সংগ্রামে গণসঙ্গীত নিয়ে; সাম্যবাদের মন্ত্রণা নিয়ে; তরুণ-যুবকদের প্রতিবাদে উদ্দীপ্ত করতে প্রশিক্ষণ দিয়ে আর গেরিলা হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ ও সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের একজন ইস্পাত কঠিন সংগঠক ছিলেন কমরেড শ্রীকান্ত দাশ। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে নিজ উদ্যোগে খুলেছেন লংগরখানা। দেশ স্বাধীন হলে যুদ্ধবিধ্বস্ত, উপর্যুপরি বন্যা-ঘূর্নিঝড়ে বিপর্যস্ত, ফসলহানি আর দাদন ও জোতদারদের নিপিড়নে দারিদ্রের কষাঘাতে কূলকিনারা হারা ভাটি এলাকার প্রান্তিক কৃষক ও ভূমিসন্তানদের অধিকার আদায়ে কমরেড শ্রীকান্ত ছিলেন নিবেদিত প্রাণকর্মী, তেজস্বি ও সাহসী। ১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারী মেঘালয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন, করমর্দন করেন, মত বিনিময় করেন, তুলে ধরেন স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালির পথ চলা।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন বিলিয়ে দেয়া কমরেড শ্রীকান্ত দাশের চোখের সামনেই সারাবিশ্বে সমাজতন্ত্রের একে একে পতন হয়েছে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে, অনেক কমরেড আদর্শবিচ্যুত হয়ে পূঁজিবাদদের সাথে হাত মিলিয়ে বিশাল অট্টালিকা ও শিল্পপতি হয়েছেন, নতুন নতুন জোটে যোগ দিয়েছেন বা নিজেরাই ফ্রন্ট গড়ে ক্ষমতার আশে-পাশে থেকেছেন, ক্ষমতার অংশীদারও হয়েছেন। কিন্তু কমরেড শ্রীকান্ত দাশ ছিলেন সেই ক্ষমতার রাজনীতির বাহিরে। তাই তিনি গেয়ে ওঠতেনঃ
“আজ দিন এসেছে চাষীমজুর দেখরে চাহিয়া
কে তোদের মুখের অন্ন নেয়রে কাড়িয়া
সাম্রাজ্যবাদের পা চাটারা দাঁড়ায়ে তোর দ্বারে
গদীর লোভে পরের হাতে তোদের বিক্রি করে,
আজ কর বিচার, দেওরে শাস্তি, সবে মিলিয়া
যারা ধোকা দিয়ে, ধান নিয়ে ভুখারে করে গুলি,
খাদ্যের দাবী করলে তারা বলে রাজদ্রোহী
আজ মার্কিনে দেশ বিক্রি করে করছে বাহাদুরি।
তারাই মোদের বিভীষণ ভাই লওরে চিনিয়া।।”

অথবা
“চাষাদের, মুটেদের, মজুরের ।।
গরিবের নিঃস্বের ফকিরের
আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের।।
নেই ভেদাভেদ হেথা চাষা আর চামারে,
নেই ভেদাভেদ হেথা কুলি আর কামারে।।
হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ।।
দেশ মাতা এক সকলের।
লাঙলের সাথে আজ চাকা ঘোরে এক তালে
এক হয়ে মিশে গেছি আমারা সে যে কোন কালে।।
মন্দির, মসজিদ, গীর্জার আবাহনে।।
বাণী শুনি একই সুরের।“

এভাবে আজীবন পরার্থপরতার রাজনীতি করেছেন কমরেড শ্রীকান্ত দাশ। ছিলেন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত তাই শেষ জীবনে এসেও প্রতিষ্ঠা করেছেন শাল্লা উদীচী। হয়েছিলেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় উপদেষ্ঠামন্ডলীর সদস্য। সংগীত, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে চিন্তা-চেতনায় ধারণ করে কাটিয়েছেন প্রত্যন্ত এলাকায়ই। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে নিজ জন্মভিটায় গড়ে তুলেছিলেন “শুদ্ধ সংগীত বিদ্যালয়”। ২০০৪ সালের ৬ অক্টোবর সিলেট কোর্টে এফিডেবিটের মাধ্যমে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেন। বেদানন্দ দাদার কাছ থেকে তাঁর মরণোত্তর দেহদানের কাহিনী শুনে আমার গায়ের পশম দাড়িয়েছিল। সেই কাহিনী নিয়ে পড়ে লিখবো। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর মৃত্যু হলে তার মরদেহ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য দান করা হয়। তিনি হলেন সিলেটের প্রথম মরণোত্তর দেহদানকারী ব্যক্তি। এমন একটি প্রত্যন্ত ও সুবিধাবঞ্চিত এলাকা থেকে ওঠে আসা ছিপছিপে গড়নের মানুষটি কীভাবে সঙ্গীত, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে একাকার করে সাম্যবাদী ধ্যানধারণায় উজ্জীবিত হয়ে ব্রিটিশ খেদাও, পাকিস্তান শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশে গণমানুষের মুক্তির পতাকা উড়িয়েছেন তা নিয়ে গবেষণার দাবী রাখে। লন্ডনে থাকাকালীন ২০১২ থেকে ২০১৯ এই আট বছর তাঁর প্রতিটি প্রয়াণদিবসে শ্রীকান্ত সংহতি পরিষদের ব্যানারে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। কোভিড সংক্রমণের কারণে গত বছর ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় কমরেড পংকজ ভট্টাচার্যসহ দেশ-বিদেশের কমরেড, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা ছিলেন। সেখানেও কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সিলেটের লোকমান ভাই ও বেদানন্দ দাদার বক্তব্যে কমরেড শ্রীকান্ত দাশের জীবনের অনেক অজানা কাহিনী ওঠে আসে।

কমরেড শ্রীকান্ত দাশের জন্মদিনে একটি পত্রিকা দেখলাম না তাকে নিয়ে দু চার লাইন লিখতে। তবে আজীবন বিপ্লবী কমরেড শ্রীকান্ত দাশদের সেজন্য কিছু আসে যায়ও না। সেজন্য তারা তাদের জীবনের স্বর্ণালী সময় বিসর্জনও দেননি। আমাদের ঘুণে ধরা সমাজে, ফেসবুক আর সোস্যাল মিডিয়ার নামে দিনে দিনে এক অসামাজিক যুগের দিকে এগিয়ে যাওয়া প্রজন্মকে সমাজসংশ্লিষ্ট করতে,ভোগবাদী এক স্বার্থপর চিন্তা-চেতনায় বুদ হয়ে থাকা আমাদের রাষ্ট্রটিকে পরার্থপরতার মন্ত্রে দীক্ষিত করার জন্য কমরেড শ্রীকান্ত দাশের জীবন ও কর্মে ফিরে যেতে হবে। আর সেজন্যই আমাদের কমরেড শ্রীকান্ত দাশ পাঠ প্রয়োজন। তাদের জীবন থেকে শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন।

ড. জহিরুল হক শাকিল, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইলঃ jahirul-psa@sust.edu

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!