1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০৫ পূর্বাহ্ন

তলিয়ে যাওয়া হাওরে: পাভেল পার্থ

  • আপডেট টাইম :: শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৭, ৫.৫৩ এএম
  • ৫৬১ বার পড়া হয়েছে

একে একে ডুবছে হাওর। পেটবোঝাই পুষ্ট, অপুষ্ট দানা নিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে ধানের জমিন। এসব ধান জমিনের বয়স বেশ প্রাচীন, বইয়ের ভাষায় বলা চলে প্রতœতাত্ত্বিক কৃষিজমি। হাওরাঞ্চল ছাড়া দেশে এমনসব ঐতিহাসিক ধান জমিন খুব একটা নেই। দেখার হাওর, শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, সজনার হাইর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর, ঘুইঙ্গাজুড়ি হাওর, জালিয়ার হাওর, বাওরবাগ, খরচার হাওর, পাথরচাউলি বা চেপটির হাওরের মত দেশের শত শত হাওরের আদি বৈশিষ্ট্যের সব জমিন আজ পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। বাংলাদেশকে যদি ছয় ভাগ করা হয়, তার এক ভাগই হাওর জনপদ। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি প্রশাসনিক জেলায় বিস্তৃত দেশের হাওরভূমি এক দু:সহ মরণযন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে। হাওরে ধান মওসুম একটাই, বোরো মওসুম। আর এই মওসুমের ধানকে ঘিরেই হাওরবাসী পুরো বছরের টিকে থাকার প্রস্তুতি নেয়। এমনিতেই চৈত্র মাসে হাওরে চলে চৈত্রের নিদান। শস্যের আকাল। এর ভেতর একমাত্র ফসল তলিয়ে গেলে সেই নিদানের রূপ কেমন হয় তা কেবল হাওরবাসীই দিনের পর দিন টের পায়। কেউ এই নিদানকালে হাওরবাসীর পাশে দাঁড়ায় না। স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় সংসদ কেউ। রাষ্ট্র বরাবরই হাওরকে এড়িয়ে চলে, হাওরের যন্ত্রণাকে আড়াল করে চলে। লাগাতার রাষ্ট্রীয় অবহেলা, অন্যায় আর অনাচারের ভেতরেই জেগে থাকে হাওর। দেশকে জোগায় ধান আর মাছ, দুনিয়াকে উপহার দেয় গান। চৈত্র-বৈশাখে অবিরত বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাওরের তলিয়ে যাওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। এটি ঐতিহাসিক এবং সুরাহাহীন ভাবেই ঘটে চলেছে। হাওরের টিকে থাকা সংগ্রামের রসদ ও বিজ্ঞান কেউ হাওরবাসীকে দান করেনি বা বাড়ায়নি কোনো সহযোগিতার হাত। হাওরের বিশেষ বাস্তুসংস্থানই হাওরবাসীকে এই অঞ্চলে টিকে থাকবার সংগ্রামে প্রতিদিন নতুনভাবে প্রস্তুত করে তুলে। রাষ্ট্র এই প্রস্তুতির দিকে ফিরেও তাকায় না। সব কিছু ডুবে তলিয়ে গেলে সরকার কিছু উফশী ধানের সিদ্ধ চালের বস্তা নিয়ে আসে। কখনো ঘর তোলার জন্য কয়েক বান্ডিল ঢেউ টিন। এর বেশি কিছু না। হাওরের উন্নয়ন বলতে রাষ্ট্র এখনো বুঝে ডুবন্ত রাস্তা, ফসল রক্ষা বাঁধ আর বাণিজ্যিক মাছ চাষর জন্য বিল জলাভূমির ইজারাকে। আর এ নিয়েই বছরভর লেগে থাকে স্থানীয় থেকে জাতীয় জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের ভেতর ভাগ-বাটোয়ারার দরবার, কোন্দল আর দুর্নীতি। হাওরের উজান-ভাটির শর্তকে কেউই মান্য করে না। বলা ভাল বুঝে না বা বোঝার মত যোগ্যতা ও সাহস দেখায় না। প্রতি বছর চৈত্র-বৈশাখে পাহাড়ি ঢলে ধান জমিন তলিয়ে গেলে এ নিয়ে কিছুদিন কথা হয়। গণমাধ্যম কিছু লেখালেখি ও প্রচার করে। তারপর আবারো সব নিশ্চুপ। আবার পরের বছরের চৈত্র মাসের তলিয়ে যাওয়া দিয়ে শুরু হয়। কেবল তর্ক চলে ফসল রক্ষা বাঁধ বানাতে কোথায় দুনীর্তি হয়েছে, কে কত ভাগ পেল কী পায়নি, কোন চেয়ারম্যান কত টাকা মেরেছে, কোন ঠিকাদার কাজ না করে চলে গেছে। কেউ কোনো দায়িত্ব নেয় না। দায় নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। হাওরের সুরক্ষাপ্রশ্নটি কোনোভাবেই বাঁধ, ইজারা আর অবকাঠামোর সাথে জড়িত নয়। সমস্যার মূল জায়ঘাটি এখানেই। হাওরের সাথে সম্পর্কহীন বা হাওরের উজান-ভাটির অংক বুঝতে না পারা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের চাপিয়ে দেয়া এমনতর দশাসইসব উন্নয়নচিন্তাই হাওরকে প্রতিবছর তলিয়ে দেয়। ডুবিয়ে মারে। বাঁধ দিয়ে কী কোনোভাই একটি জলজ বাস্তুসংস্থানের সুরক্ষা হয়? শনির হাওরের জন্য বাঁধ দিলে মাটিয়ান হাওর ডুবে মরে। হাকালুকির উত্তরে বান দিলে দক্ষিণে নিদান শুরু হয়। হাওরের সুরক্ষাকে রঙবেরঙের উন্নয়নের রোদচশমা চোখে দিয়ে নয়, দেখতে হবে হাওরের চোখেই। হাওরবাসীর উজান-ভাটির অংক থেকেই।

২.
তো, হাওরের এই উজান-ভাটির অংকটি কী? হাওরাঞ্চলগুলো ভাটিতে অবস্থিত। এ কারণেই হাওরাঞ্চল হলো দেশের ভাটি-বাংলা। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল গুলো হলো হাওরের সাপেক্ষে উজান অঞ্চল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রায় হাওরগুলোই উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের কাছাকাছি। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি উজানে জন্ম নিয়েছে শত সহ¯্র পাহাড়ি ঝর্ণা ও ছড়া। এই পাহাড়ি জলধারাই বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর উৎসস্থল। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি ও বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল দুনিয়ার দুই বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল হাওরাঞ্চলেই অবস্থিত। চৈত্র-বৈশাখের বর্ষণের ঢল উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানের পাহাড় থেকে বাংলাদেশের ভাটির হাওরের নেমে আসে বলেই এই ঢল ‘পাহাইড়্যা পানি বা পাহাড়ি ঢল’ নামে পরিচিত। আর পাহাড়ি ঢলেই আজ তলিয়ে যাচ্ছে ভাটির হাওর। পাহাড়ি ঢলের ফলে তৈরি প্লাবিত এই অসনীয় অবস্থাকে হাওরের অভিধানে বলে ‘আফাল’। কালবৈশাখী ঝড় আর বাতাসের গতি আটকে পড়া পাহাড়ি ঢলের পানিতে ‘আফরমারা’ তীব্র ঢেউ তৈরি করে, যা আফাল অবস্থাকে আরো জটিল ও দু:সহ করে তুলে। পাহাড়ি ঢল থেকে হাওরের সুরক্ষায় অবশ্যই আফাল ও আফরমারাকে বুঝতে হবে। ইট-সিমেন্টের বাঁধ ঘিরে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের হিসাব দিয়ে কোনোভাবেই হাওরকে বোঝা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানের পাহাড় আর ভাটির বাংলাদেশের হাওরের এই সম্পর্ক কত দিনের? সম্পর্কটি যদি ঐতিহাসিক হয়, তবে আজ কেন ভাটিতে এই যন্ত্রণা? নাকি এভাবেই হাওর তলিয়ে যেত? এক কথায় উত্তর হচ্ছে, না। হাওরের সাথে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ের সম্পর্কটি ঐতিহাসিক। মৈমনসিংহ গীতিকা ও সিলেটি বারোমাসীর মতো হাওরের প্রাচীন দলিল গুলোতে এর সত্যতা মেলে। উজানের পাহাড় থেকে জল গড়িয়ে নামতো ভাটির হাওরে। এ যেন নাইওরী আসা, জলের নাইওরী। পুরো বর্ষাকাল এই জল নাইওরী কাটিয়ে নানান নদীর প্রবাহে চলে যেত সমুদ্রে। পাহাড় থেকে সমুদ্র, জলপ্রবাহের এই দীর্ঘ পরিভ্রমণে হাওরাঞ্চল পেত বৈশাখী জলের এক বিশেষ স্পর্শ। এই স্পর্শে কোনো আঘাত, যন্ত্রণা বা তলিয়ে যাওয়ার ছল ছিল না। বরং ওই জলে জীবনের টান ছিল। রাধারমণ থেকে শাহ আবদুল করিম কেউই এই জলের টান অস্বীকার করতে পারেননি। আর তাই এখনো সেই টান জাগিয়ে রাখেন ভাটির নারীরা ধামাইল গানের নাচে, …জলে গিয়অছিলাম সই, জলে গিয়াছিলাম সই, কালা কাজলের পাখি দেইখ্যা আইলাম অই। রাধারমণের এই ধামাইল গীতে দেখা যায়, জলে গিয়ে কাল কাজলের পাখির সাথে সাক্ষাৎ করে আবার ফিরে আসা যায়। কিন্তু এখন যায় না। এখন কালা কাজলের পাখিসহ প্রেমিক দর্শনার্থী নিজেও দুম করেই পাহাড়ি ঢলের তলায় হারিয়ে যায়। ডুবে ভেসে যায়। তো এমন অবস্থাটি কেমন করে হলো?

৩.

ইউরোপ থেকে ধনী হয়ে ভাগ্য বদলানোর জন্য রবার্ট লিন্ডসে সিলেটে এসেছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশকালে। ব্রিটিশ রানীকে ঘুষ দিয়ে বারো বছর সিলেট শাসন করেছেন। লিন্ডসে তার লেখায় তখনকার ভাটির সিলেট ও উত্তরপূর্ব ভারতের যে বিবরণ দিয়েছেন সেখানেও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাওয়ার কোনো হদিশ নেই। বরং পাহাড় ও হাওরের পুরো অঞ্চল জুড়ে গভীর বনভূমির কথা আছে। এমনকি সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলের হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো ভিন্ন বৈশিষ্ট্যর জলাবন। হাওর অভিধানে তাই ‘করচের বাগ’, ‘হিজলের বাগ, ‘নল-নটার বন, ‘ইকর-আটিয়ার বন’ এগুলো খুবই প্রচলিত শব্দ। মেঘালয় পাহাড় জুড়ে যেমন মিশ্র বর্ষারণ্য, হাওর জুড়ে জলাবন। চৈত্র-বৈশাখের কালবৈশাখী থেকে শুরু করে অবিরাম বর্ষণ উজানের বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে ভাটিতে গড়িয়ে পড়তো। এসব পাহাড়ি বনে বুনো লতা, ঘাস, গুল্ম এবং বৃক্ষের আচ্ছাদন বৃষ্টির পানির ধারাকে দুম করে গড়িয়ে পড়তে বাধা দিত। পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি ‘ছাঁকনি বা চুইয়ে পড়া নীতিতে’ উজান থেকে ভাটির হাওরে নামতো। ১৯৬০ সনের দিকে এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরও পাহাড়ি ঢলের এই নামতা হাওরবাসীর মুখস্থ ছিল। এ একটি হাওর এক এক ভৌগলিক দূরত্বে অবস্থিত। টাঙ্গুয়ার হাওরে ঢল নামলে মাটিয়ান বা খরচার হাওর পর্যন্ত আসতে কত সময় লাগবে সেই হিসাব মানুষের ছিল। আকাশের নানা কোণে কী রঙের কী ধাঁচের মেঘ জমল তাই দেখে হাওরের বুড়ি গুলো আগে আফালের হিসাব কষতে জানতো। এখন এসব বুড়ি গুলোও নেই আর প্রবীণ জংগল গুলোও নেই। পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তের প্রাকৃতিক বনভূমি বিনাশ করে ভারত বহুজাতিক খনি প্রকল্প তৈরি করেছে। মেঘালয় পাহাড় আজ কয়লা আর চুনাপাথর তুলতে তুলতে ফাঁপা হয়ে গেছে। অল্প বিস্তর বৃষ্টিতেই আজ মেঘালয় পাহাড় ভেঙে পড়ছে বাংলাদেশের হাওরে। এখন উজানের পাহাড় থেকে ঢল নয়, নামে পাহাড়ি বালি ও পাথর-কাঁকরের স্তূপ। উজানের পাহাড়ি বালিতে হাওর ভাটির প্রায় নি¤œভূমি, জলাঅঞ্চল, বিল ও নদীগুলো আজ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ভরাট হয়ে যাওয়া হাওরভূমিতে এখন বৃষ্টির পানি ধরে রাখবার মতো বৈশিষ্ট্য নেই। তাই অল্প বৃষ্টি, এমনকি চৈত্রের প্রথম বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় হাওর। প্লাবিত হয়, মূলত বৃষ্টির জল কোথাও প্রবাহিত হতে না পেরে হাওর ভূমির কৃষি জমিতেই ছড়িয়ে পড়ে, প্লাবিত হয়। তাই মূলত ডুবে যায় হাওরের ধান জমিন গুলো। মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়েই দুনিয়ার এক বিশেষ বন অবস্থিত। বালফাকরাম সংরক্ষিত বনভূমি। বালফাকরামের ভাটিতে কিন্তু পাহাড়ি ঢলে এখনো তলিয়ে যায়না সেখানকার নি¤œাঞ্চল। এ তো গেল উজানের কথা, ভাটিতে কী তাহলে জলপ্রবাহের অংক ঠিক আছে? না ভাটিতেও উজানের মতই প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহকে গলাটিপে হত্যা করা হচ্ছে। ভাটির বাংলাদেশ সবগুলো হাওর ধনী ও প্রভাবশালীদের ইজারা দিয়ে হাওরকে বানিয়ে রেখেছে বাণিজ্যিক মৎস্য খামার। যে পাহাড়ি বালি হাওরের জন্য আজ অন্যতম প্রধান সমস্যা সেই পাহাড়ি বালি পাথর বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে একদল মুনাফাখোর। এই জল ও বালিমহাল ইজারাদার কী দখলদারেরাই হাওরের অর্থনীতি থেকে আজ রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করছে। এরা মনে প্রাণে চায় মেঘালয় পাহাড় ভেঙে হাওর ভরাট হয়ে যাক এবং বছর বছর তলিয়ে যাক। উজানের খনি ব্যবসায়ী ও ভাটির ইজারাদারেরা মূলত একই নয়াউদারবাদী করপোরেট মনস্তত্ত্ব ধারণ করে। ভাটির বাংলাদেশে হাওর ইজারা নিয়ে প্রাকৃতিক জলাভূমিতে আগ্রাসি হাইব্রিড বিপদজনক মাছদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হাওরের নানা জায়গায় বান দিয়ে জলতরঙ্গ আটকে দেয়অ হয়েছে। হাওরের নদী ও প্রবাহগুলোকে আটকে দেয়া হয়েছে। মানে হাওরের উজান ও ভাটি আজ সব খানেই সব দিকে থেকে বন্ধ, শৃংখলিত ও আবদ্ধ। তাহলে কী বৃষ্টি হবে না? পানির ধর্ম বদলে যাবে? পানি তো উজান থকে ভাটিতে গড়াবেই। তাহলে উজান থেকে ভাটিতে বৃষ্টির ঢলকে গড়িয়ে যাওয়ার পথ গুলো বারবার বন্ধ করে যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বারবার করা হচ্ছে তা কোনোভাবেই হাওরের সুরক্ষা দিতে পারেনি। চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। হাওরের এই উজান-ভাটির অংকটি সচল রাখার দাবি কোনোভাবেই আজকের নতুন নয়, ভাসান পানির আন্দোলনেরও আগ থেকে হাওরবাসী এই দাবি করে আসছেন। কিন্তু রাষ্ট্র এটি কোনোভাবেই কানে তুলছে না। রাষ্ট্র হাওরকে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিয়েছে। নয়াউদারবাদী মুনাফার ময়দানে জিম্মি হয়ে আছে হাওর। পাহাড়ি ঢলে হাওরের এই তলিয়ে যাওয়া বিষয়টি পুরোপুরো একটি আন্ত:রাষ্ট্রিক সংকট। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশগ্রহণের ভেতর দিয়েই এক বহুপক্ষীয় জলাভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণের ভেতর দিয়েই কেবল এর সুরাহা সম্ভব। কারণ এখানে উজান ও ভাটির প্রশ্নটি পরস্পরনির্ভরশীল। কিন্তু এসব আমরা কখনো বিচার করছি না। হাওরের অভিন্ন নদী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন কখনোই কোনো ন্যায়বিচার করেনি। তাহলে কীভাবে হবে? চৈত্র-বৈশাখে তো হাওর তলিয়েই যাবে। কারণ ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্র যে উন্নয়ন বাণিজ্য চালু রেখেছে তাতে হাওর বছর বছর ডুববে। আর হাওরবাসী দিন দিন হাওর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। হাওরে জনমিতির এক ভয়াবহ ধস নামবে।

৪.
বছর বছর হাওর তলিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এর পূর্ণাঙ্গ কোনো তদন্ত, হদিশ ও গবেষণা করে না। কেউ দায়িত্ব নেয় না, দায় স্বীকার করে না। অথচ হাওর ও জলাভূমি উন্নয় বোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। জনগণের পয়সায় এটি চলে। কিন্তু বছর বছর পানিতে হাওর তলিয়ে গেলেও এই প্রতিষ্ঠানটির কোনো চেহারা কোথাও দেখা যায় না। ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি তারিখে এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ গঠিত হয় এবং ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ১১ সেপ্টেম্বর ২০০০ সালে এক রিজলিউশনের মাধ্যমে দেশের সকল হাওর ও জলাভূমি সমন্বিতভাবে উন্নয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পুনরায় ‘ বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ কে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত অফিস হিসেবে অর্ন্তভূক্ত করেন ( নং পাসম-উঃ৫/বিবিধ-১৯/২০০০/৩৮৩, সূত্র : বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যা, ২৬/৯/২০০০)। হাওর উন্নয়ন বোর্ড যদিও হাওর উন্নয়নে হাওর সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়সমূহকে সমন্বিত করে কাজ করার কথা বলেছেন কিন্তু হাওর এলাকার কোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পে তার কোনো ছাপ হাওরবাসীরা দেখতে পান না। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডকে এখনও পর্যন্ত বাস্তবিকভাবে কার্যকরী করে না তোলা হলেও বোর্ড গঠনকালে বলা হয়েছিল, এই বোর্ড হাওর ও জলাভূমির সার্বিক ও সমন্বিত উন্নয়ন সাধনকল্পে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/সংস্থা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে সমন্বয় ও সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করিবে। এই লক্ষ্যে বোর্ড হাওর ও জলাভূমির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত মাষ্টার প্ল্যান তৈরীর পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে ( সূত্র: নং পাসম-উঃ৫/বিবিধ-১৯/২০০০/৩৮৩, সূত্র : বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যা, ২৬/৯/২০০০)। সম্প্রতি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ হাওর ও জলাভুমি উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশের জন্য সেই আকাংখিত ‘মাস্টার প্ল্যানটি’ তৈরি করেছে। ২০১২ সনের এপ্রিলে প্রকাশিত তিন খন্ডের এই হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনাটি ৬ টি ধাপে প্রস্তুত করা হয়েছে। বলা হয়েছে ১০টি হাওর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ৩০টি দলগত আলোচনার ভিত্তিতে এটি করা হয়েছে। আসলে চরম মিথ্যাচার হয়েছে। কারণ হাওর মহাপরিকল্পনায় হাওরের এই পাহাড়ি ঢলের মতো অন্যতম প্রধান সমস্যাটিকে হাওরবাসীর চোখে দেখা হয়নি। কারণ হাওরবাসী এই সমস্যাকে একটি আন্ত:রাষ্ট্রিক সংকট হিসেবে দেখেন। এই সমস্যার সমাধানে লাখ লাখ কোটি কোটি বাঁধ ও ব্যারাজ বানিয়ে কোনোভাবেই হাওরের বাস্তুসংস্থান সুরক্ষা করা যাবে না। হাওর ও জলাভূমি বোর্ডকে মূলত পাহাড়ি ঢলে হাওর তলিয়ে যাওয়ার যাবতীয় দায় ও দায়িত্ব নিতে হবে। তাদেরকে হাওরবাসীর সামনে আসতে হবে, সকল কিছুর কারণ ব্যাখা করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বছর বছর পাহাড়ি ঢলে জমিন ও জনপদ তলিয়ে যাওয়ার যাবতীয় ক্ষতিপূরণ, শস্যবীমা, বীজবীমা, শিক্ষাবীমা ও স্বাস্থ্যবীমার প্রচলন ঘটাতে হবে হাওরাঞ্চলে। হাওরের অবকাঠামো ও ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে চলমান সস্তা ‘ভিলেজ পলিটিক্স মার্কা’ দরবারকে রাজনৈতিক কায়দায় ফায়সালা করে, পাহাড়ি ঢলে হাওরের তলিয়ে যাওয়াকে একটি আন্ত:রাষ্ট্রিক সংকট হিসেবেই বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

৫.

চৈত্র-বৈশাখে পাহাড়ি ঢল নামে হাওরে। এ কারণেই হাওর জন্ম দিয়েছে অবিস্মরণীয় সব গভীর পানির ধান জাত। গচি, রাতা, টেপী, বোরো, দীঘা, লাখাই থেকে শুরু করে চুরাক ধান। এসব ধান পাহাড়ি ঢলের পানিতেও তলিয়ে যায় না। প্লাবিত জলেও টানা বাঁচতে পারে। এসব জাত আগাম বলে পাহাড়ি ঢলের আগেই এসব জাত ঘরে তুলতে পারতো হাওরবাসী। কিন্তু তথাকথিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে রাষ্ট্র হাওরবাসীর কাছ থেকে এসব ধান জাত কেড়ে নিয়েছে। হাওরবাসীর হাতে চাপিয়ে দিয়েছে খর্বাকৃতির উফশী ধানের জাত। মূলত চালু হয়েছে সিনজেনটা, মনস্যান্টো কোম্পানির বিষ ব্যবসা। প্রতিটি সরকারই এসব কোম্পানিকে তোয়াজ করে চলে। তাই এসব কোম্পানির বিষের ব্যবসা চাঙ্গা হয়। কিন্তু মরে কৃষক, মরে মাটি আর মরছি আমরা যারা এসব খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। পৃথিবীর প্রথম গভীর পানির ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিও তৈরি হয়েছিল হবিগঞ্জের নাগুড়ার হাওরাঞ্চলে। এখন এটি তো মৌলিক প্রশ্ন রাষ্ট্র তেন সেটি ধরে রাখতে পারলো না? হাওরের গভীর পানির ডুবো জাতের ধানগুলি কেন সুরক্ষা করলো না? তাহলে কীভাবে ধান রক্ষা পাবে? ফসল রক্ষা বাঁধ দিয়ে? যাতে কিছু ঠিকাদারের দালান বাড়ি তৈরি হয়।

৬,

হাওরের সংকটকে হাওরের চোখেই দেখতে হবে। না জেনে না বোঝে হাওরের চলমান সংকটকে কোনোভাবেই ‘জলবায়ু পরিবর্তনের’ ফলাফল হিসেবে ব্যাখা করা ঠিক হবে না। যারা এভাবে জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাইছে এতে প্রমাণিত হয় কেবলমাত্র হাওর নয়, জলবায়ু বিষয়টিও তাদের কাছে বিমূর্ত ও অস্পষ্ট। আর কয়েক দিন পরেই হাওরে ছিল বৈশাখী। বিষু সংক্রান্তি। বেগুনপাতার বর্ত আর চড়কের আয়োজন এ বছর হয়তো বিষাদগ্রস্থ হয়েই রইবে। এক মুঠ ধানও ঘরে তোলা যায় নি। ধান তো কেবলমাত্র খাদ্যদানা নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো বছরের জটিল বিশ্বাস ও সম্পর্ক। যখন পাহাড়ি ঢল এগিয়ে আসছে এ বছর, হাওরবাসীরা প্রকৃতির কাছে কত মিনতি করেছেন, শেষমেষ ধানের জমিনের কাছে ক্ষমা চেয়ে রক্ষা করতে না পেরে চলে এসেছেন। একজন কৃষক তার নানা পরিচয়, একইসাথে উৎপাদক ও সুরক্ষাকারী। যে কৃষক বালামুসবিত থেকে তার উৎপাদনের সুরক্ষা দিতে পারে না, শুধু সেই জানে বুকের ভেতর তার কেমন ছাড়খাড় হয়ে যায়। পাহাড়ি ঢলে হাওরের তলিয়ে যাওয়া কৃষকের কাছে এক প্রশ্নহীন পরাজয়। কৃষক কখনোই এমন পরাজয় মেনে নিতে পারে না বলেই বছর বছর সংগ্রামী জমিন সাজায়। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কী এমন পরাজয় মেনে নিয়েই আগামীর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে চায়?
লেখক: পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র গবেষক:

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!