ফেইসবুকের টাইমলাইনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোষাক পড়ে জমিতে ধানকাটার এক মুকানিভয়ে নেমে পরেছে একশ্রেণীর তরুণ, নেতা, খেতা! অনেক ছবিতে দেখা যাচ্ছে নিরুপায় কৃষক তাদের উদ্যেশ্য বুঝতে না পরে অনেকটা ভ্যাবচেকা খেয়ে চোয়াল শক্ত করে জমির অন্য প্রান্তে নিশ্চুপ বসে আছে। কেনো জানি মনে হচ্ছে কৃষকদের সাথে এক ধরনের তামাশায় লিপ্ত হয়ে পরেছে এদেশের মানুষ।
আমি একজন আপাদমস্তক কৃষক পরিবারের সন্তান। এসএসসি পরীক্ষা পাশ করার পৃর্ব পর্যন্ত গ্রামের সব ধরনের কৃষিকাজে আমার সক্রিয় অংশ গ্রহণ ছিলো। শুধু আমিই নয়, আমাদের পরিবারের সব ভাই-বোনদের পড়াশুনার পাশাপাশি কৃষিকাজে অংশগ্রহণ অনেকটা বাধ্যতামূলক ছিলো। কারন কৃষির উপর নির্ভর করেই আমাদের বিশাল পরিবারের সারা বছরের ভরন-পোষন,ঔষুধ-পত্র, স্কুলের বেতন, খাতা-কলম, পোষাক-আষাক, বিশেষ কোন আচার-অনুষ্ঠানের অর্থ সব কিছুই জোগার হতো। কোন বছর যদি জমিতে ফসল কম হতো কিংবা বাজারে যদি কাংখিত মূল্য না পাওয়া যেতো, সে বছর পরিবারের বড়দের মন খারাপের সাথে আমরা ছোটরাও বিশেষ মন খারাপ করতাম। স্কুলের বেতন, খাতা-কলম, ঈদের সময় নতুন পোষাক পাওয়ার এক তীব্র অনিশ্চয়তায় সময় কাটাতে হতো। পরের বছর বাম্পার ফলন কিংবা ভালো দামের অাশায় ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকতাম।
গ্রামের প্রায় সব পরিবারেরই এটা ছিলো কমন চিত্র।
পড়াশুনার পাশাপাশি পরিবারের সবাই মিলে কৃষি কাজ করতাম। জমিতে হাল-চাষ, বীজ বপন, সময় মতো নিড়ানি দেয়া, সার দেয়া, পানি দেয়া, ফসল ঘরে তোলা, বাজারজাত করা সব কাজেই অংশ গ্রহণ ছিলো তখনকার ছেলে-মেয়েদের প্রধানতম কাজ। মাঝেমধ্যে কাজ বেশি হলে কামলা রাখা হতো। কাজের চাপ খুব বেশি হলে স্কুল কামাই করা হতো। এতে করে পড়াশুনার কিছুটা ক্ষতি হলেও পরিবারের বিরাট লাভ হতো। কামলার জন্য অতিরিক্ত খরচ বেঁচে যেতো।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় গ্রাম-বাংলার সেই চিত্র এখন বদলে গেছে। অনেকটা সাহেবী স্টাইলের পড়াশুনায় ছেলে-মেয়েরা নিজেদেরকে গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দিয়ে নামে মাত্র শিক্ষিত হওয়ার ধান্ধায় মেতে উঠেছে। পড়াশুনার পাশাপাশি কৃষিকাজ যেনো এক অপমানকর পেশা, সবার চাল-চলনে এটাই ফুটে উঠতেছে। ছেলে-মেয়েদের সাহেবী স্টাইল বজায় রাখতে গিয়ে নিরুপায় কৃষক পিতা-মাতা প্রায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। একদিকে নিজ পরিবারের কৃষিকাজের কর্মী কমে যাওয়াতে বাইরের কর্মীর নিয়োগ দিয়ে কাজ করে নেয়াতে পরিবারের কৃষি খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের হালের নতুন ফ্যাশন যেমনঃ প্রাইভেট-কোচিং এর খরচ, মোবাইল খরচ, গ্যাংগাম স্টাইল জামা-জুতার খরচ ইত্যাদির খরচ জোগাতে কৃষি নির্ভর পিতা-মাতাকে প্রতিনিয়ত গলগর্দম পোহাতে হচ্ছে।
এরপরও যদি কৃষক তার কষ্টার্জিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পায়, সরকারের নতজানু নীতির কারনে সিন্ডিকেটের নামক কিছু অসৎ ব্যবসায়ীরা কৃষকের ফলানো ফসল কুক্ষিগত করে ফেলে, তাহলে তাঁরা যাবে কোথায়? তখন মাথায় হাত দেয়া ছাড়া কিংবা কৃষিকাজ ছেড়ে দেয়া ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প কোন পথই খোলা থাকে না।
মরার উপর খরার ঘা হচ্ছে রাষ্ট্রের দূর্বলতা এবং সাধারন মানুষের সরলতাকে পুজি করে এদেশের এক শ্রেণীর দুই নম্বর লোকেরা নামকাওস্তে উচ্চ শিক্ষার অনেক প্রতিষ্ঠান খুলে বসছে। গ্রাজুয়েশনের নামে এদেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক সন্তানদের তারা একটা বিশাল ফাঁদে আটকে ফেলে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। ঐসব প্রতিষ্ঠান থেকে নামে মাত্র পাশ করা ছেলে-মেয়েরা না হয় শিক্ষিত, না হয় কোন কর্মঠ মানুষ। চাকুরী নামক সোনার হরিণকে ধরতে এরা অনেক সময় বাবা-মায়ের কৃষি জমি বন্ধক কিংবা বিক্রি করাতে বাধ্য করে নতুবা বেকার হিসাবে কৃষক পিতা-মাতার আমড়া কাঠের ঢেঁকি হয়ে বাকী জীবন পার করে।
আমাদের দেশের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে মৌলিক এবং পবিত্রম মানুষ হলো আমাদের কৃষক! কারন রোদ-তাপ সহ্য করে, খরা-বৃষ্টিতে ভিজে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে পেছনে ফেলে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, ঝোঁক-পোকের কামড় খেয়ে এদেশের আপামর মানুষের উদরপূর্তি রসনার খাদ্যের যোগান দেয় একমাত্র কৃষক।প্রায় সব শাসক দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে তাঁরাই। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দেখা যায় তাঁরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত, সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। তাঁদের উৎপাদিত পণ্য তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ন্যায্য মূল্যের অধিকারহীন। এদেশের নিরুপায় কৃষকদের দেখে যে দুটি কবিতার লাইন মনে পরে তা হচ্ছে-
‘ডিম পাড়ে হাসে
খায় বাগদাসে!’
বছরের পর বছর খবর নাই! কেবল একদিন নতুন লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা, পাতলা পড়ে জমিতে গিয়ে ধান কাটার ভান ধরলেই কৃষক প্রেমী হওয়া যায় না। প্রকান্তরে তা অনেকটা কৃষকের সাথে তামাশারই নামান্তর। তাঁদের ফলানো ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ, দূর্নীতিমুক্তু আধুনিক কৃষি উপকরণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনয়ন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, প্যান্টপড়া সব অফিস -আদালতে তাঁদের যথাযথ অধিকার ও সন্মান প্রতিষ্ঠাকরণ, উদ্ধৃত ফসলের সঠিক জমায়েতকরণ এবং পারিবারিক কৃষিকাজে পড়াশুনার পাশাপাশি সন্তান-সন্তুুতিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে সহায়তার হাত বাড়ালেই বেঁচে যাবে কৃষক। আর কৃষক বেঁচে গেলে বেঁচে যাবে এদেশের ১৮ কোটি রসনার পেট।