1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
শুক্রবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৪৬ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::
সুনামগঞ্জে ৪০ শিক্ষার্থীকে নিয়ে জনউদ্যোগের সংগীত শেখা কর্মশালা সুনামগঞ্জে বিএনপির ৮০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশ এসল্ট মামলা জাতীয় নির্বাচনে জাপার মনোনয়ন বিক্রি কাল থেকে শুরু সুনামগঞ্জের ৫টি আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কিনলেন ৩৩ নেতা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হাওরবাসী উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে নৌকার মনোনয়ন কিনলেন আল আমিন চৌধুরী সুনামগঞ্জে পুলিশ বিএনপি সংঘর্ষে সহকারি পুলিশ সুপার ও ওসিসহ ৭ পুলিশ আহত জামাত বিএনপির নাশকতার বিরুদ্ধে এমপি মানিকের শোডাউন সিলেট থেকে ৪৫ যাত্রীকে অফলোডের ঘটনা য় বিমানের চেয়ারম্যানকে লিগ্যাল নোটিশ সুনামগঞ্জে ৬৬টি প্রকল্প উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী, চারটি উপজেলা গৃহহীন-ভূমিহীন মুক্ত ঘোষণা

চোখের জলে কাকন বিবিকে বিদায় জানালো এলাকাবাসী

  • আপডেট টাইম :: শুক্রবার, ২৩ মার্চ, ২০১৮, ২.১২ পিএম
  • ৪৮২ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি:: ঝিরারগাও থেকে ফিরে::
‘ও মাইগো। আমার খেউ নাইগো। মাই আমারে এতিম খইরা গেছইনগিগো।’ কাকন বিবির একমাত্র মেয়ে সকিনা বিবি এভাবেই মা বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা কাকন বিবিকে হারিয়ে বিলাপ করছিলেন। প্রতিবেশিরা শান্তনা দিচ্ছিলেন আর চোখের জল মুছছিলেন। তারা খাইমারা নদীতীরের ছায়াঘেরা বাড়িটিতে এসে সকিনা বিবিকে শান্তনা দেওয়ার পাশাপাশি ঘরের ভেতরে বিভিন্ন সময়ে পুরস্কার ও সম্মাননা পাওয়া ছবি-ক্রেস্ট দেখছিলেন। এলাকার প্রবীণতম এই নারী মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়ে অনেককেই বিলাপ করতে দেখা গেল। তারা চোখের জলে শেষ বিদায় জানিয়েছেন বাংলাদেশের জন্মযোদ্ধা এই নারীকে। শেষ বিদায় জানাতে আসা মুক্তিযোদ্ধা জনতা যুদ্ধদিনের তার আতœত্যাগের কথা স্মরণ করে তার বীর প্রতীক খেতাব রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ তার স্মৃতিরক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
বুধবার রাত সোয়া ১১টায় বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তার মৃত্যুর পরই বিশিষ্টজনেরা ছুটে যান সেখানে। দুপুর ১টায় সিলেট থেকে এম্বুলেন্সযোগে কাকন বিবির গ্রাম দোয়ারাবাজার সীমান্তের লক্ষীপুর ইউনিয়নের ঝিরারগাও গ্রামে আসে। তার মৃত্যুর খবর পেয়েই এলাকাবাসী সকাল থেকে তার বাড়িটিতে জড়ো হন। লাশ এসে বাড়িতে পৌছার পর একনজর দেখার জন্য ভীড় জমান এলাকাবাসী। তারা তার মৃত্যুতে নানা স্মৃতি রোমন্থন করেন। বেলা সোয়া তিনটায় লক্ষীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন খেলার মাঠে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানো হয়। বিউগলের করুণ সুরে সম্মাননা জানায় পুলিশ। এসময় জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. বরকতুল্লাহ খান, উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী বীরপ্রতীক, আব্দুল মজিদ বীরপ্রতীক, আব্দুল হালিম বীরপ্রতীকসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। সাড়ে ৩টায় তার নামাজে যানাজা অনুষ্ঠিত হয়। যানাজানায় জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারও মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। শেষে তার বসতঘরের সামনে বাংলাবাজার-রাবারড্যাম সড়কের পশ্চিমের পাশে দাফন করা হয়।
এলাকাবাসীর স্মৃতিরোমন্থন
গ্রামের সত্তোরোর্ধ আলী আহমদ ছিলেন কাকন বিবির প্রতিবেশি। কাকন বিবিকে ১৯৯৭ সালে সরকারের পক্ষ থেকে যে এক একর খাসভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছিল সেই ভূমি ছিল এই আলী আহমদের দখলে। তিনি স্বেচ্ছায় কাকন বিবিকে দখল ছেড়ে দিয়েছিলেন। আলী আহমদ বলেন, গত ২০-২৫ বছর ধরে তাকে চিনি। এমন সহজ সরল মানুষ আমি আর জীবনে দেখিনি। তিনি বলেন, কাকন বিবির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ বড় বড় কর্মকর্তাদের সম্পর্ক ছিল। তারা তাকে শ্রদ্ধা করতেন। এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আমরা কিছুটা সুবিধাও পেয়েছি। তার কারণে সরকার এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ দিয়েছিল। গ্রামীণ কয়েকটি রাস্তাঘাটও হয়েছে তার কারণে। প্রতিবেশি শামছুল হক (৭০) বলেন, কাকন বিবি নিরব বাড়িতে নিরব হয়েই থাকতেন। গ্রামের মানুষ তার কাছে তেমনটা না মিশতোনা। তবে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করতো। তিনি বলেন, তার শেষ স্বপ্ন ছিল বাংলাবাজার-রাবারড্যাম সড়কটি পাকাকরণের। এ ব্যপারে প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকের কাছেই তার শেষ স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় ১৫-২০ বছর আগে এসেছিলেন তিনি। একটি খুপড়িঘর করে নদীর পাশে থাকতেন। গ্রামের পুরনো বাজারটিতে মাছ, শুটকি বিক্রি করে জীবন চালাতেন। আওয়ামী লীগের আমলে তার খোজ শুরু হলে কিছটু সহায়তা পান। তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করেছেন কাকন বিবি। ভিক্ষাও করেছেন।
গ্রামের যুবক দেলোয়ার হোসেন বলেন, দরিদ্র কাকন বিবি গ্রামের দরিদ্রদের ¯েœহ করতেন। গ্রামের অসহায় কয়েকটি পরিবারের তরুণকে তিনি চাকুরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তিনি এলাকার গরিব কয়েকজন ছেলেকে চাকুরি দিয়ে গেছেন। এর জন্য কোন বিনিময় নেননি।
আবেগাপ্লুত সহযোদ্ধারা
১৯৭১ সালে স্বামীকে খুজতে বের হয়ে সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন কাকন বিবি। এরপরই প্রতিশোধ নিতে মুক্তিযোদ্ধা হন। যুদ্ধকালীন গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে টেংরাটিলায়। এখানে তিনি নির্যাতিত হয়েছেন। টেংরাটিলার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ বীরপ্রতিক বলেন, কাকন বিবি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। ছদ্মবেশে পাকিস্তানী হানাদারদের খবর পৌছে দিতো আমাদের কাছে। দেশের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে সে চরম নির্যাতিত হয়েছে। নারীজীবনের শ্রেষ্ট সম্পদ সম্মান হারিয়েছে। তার স্মৃতি রক্ষায় প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তার নামে স্মৃতিবাহী স্থাপনার নামকরণ করতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম বীরপ্রতীক কাকন বিবির ঘোষিত বীরপ্রতীক খেতাব কার্যকর না হওয়ায় ক্ষুব্দ হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও সরকার কাকন বিবিকে যোগ্য সম্মান দেয়নি। একাত্তরে কাকন বিবি যে সাহস দেখিয়েছেন তার জন্য আমরা ঋণি। তিনি তার সম্ভ্রম হারিয়ে এদেশের পতাকাকে রাঙিয়েছেন। কিন্তু এই স্বাধীন রাষ্ট্রে তাকে দেওয়া বীরপ্রতীক খেতাব কার্যকর করতে পারেনি। অবিলম্বে ঘোষিত খেতাব গেজেটভুক্ত করার আহ্বান জানান তিনি। দোয়ারাবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী বীর প্রতীক বলেন, আমাদের অঞ্চলে আদিবাসী সমাজের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা তিনি। একাত্তরের তার আতœত্যাগ কোনকিছু দিয়েই পূরণ সম্ভব নয়। তার স্মৃতি ধরে রাখতে হবে। এজন্য প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে।
দেয়ালে ঝুলে আছে সম্মাননা স্মারক
চারটার দিকে বসতঘরের সামনে উঠোনের কোণে দাফন চলছিল কাকন বিবির। তার টিনশেডের বসতঘরটিতে ডুকে দেখা গেল এলাকার নারীরা জড়ো হয়েছে। ছোট ছোট চারটি কক্ষে কোন আসবাবপত্র নেই। দুটি খাট। এলোমেলো ছড়ানো কিছু জিনিষপত্র। নারীদের কেউ দাড়িয়ে, কেউ বসে দেখছিলেন দেয়ালে ঝুলানো তার কিছু ছবি ও বিভিন্ন সময়ে পাওয়া ক্রেস্ট। এর মধ্যে দেয়ালে আলপিন দিয়ে বাধাই করানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জনতাব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের সঙ্গে হাস্যজ্জ্বেল ছবিটি। এর নিচেই ২০১১ সালে দৈনিক কালের কণ্ঠের সহায়তার প্রতীকি চেক ও সম্মাননা ক্রেস্ট। পাশেই বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত ক্রেস টাঙ্গানো। মনোযোগ দিয়ে সেই স্মৃতিবাহী ছবি ও ক্রেস্টগুলো দেখছিলেন নারীরা। তাদের চোখ ছিল জলে টলোমল। গ্রামের নাহিদা আক্তার চোখের জল মুছে ফেলে বলেন, কাকন বিবি ছিলেন আমাদের কাছে এক সম্মানের নাম। তিনি একজন নারী হয়েও যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। নারী হয়েই তিনি এলাকার অনেক উন্নয়নও করে গেছেন। এলাকার মানুষ তাকে আজীবন মনে রাখবে।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বক্তব্য
পুলিশ সুপার মো. বরকতুল্লাহ খান বলেন, কাকন বিবি ছিলেন আমাদের প্রেরণা। তার আতœত্যাগে আজকের এই বাংলাদেশ দাড়িয়ে আছে। এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে কাকন বিবিদের স্মৃতিও অম্লান থাকবে। কাকন বিবির স্মৃতিরক্ষায় প্রশাসন কাজ করে যাবে বলে জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, কাকন বিবি আমাদের স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। তার কারণেই আমরা ডিসি-এসপি হতে পেরেছি। কোনওভাবেই আসলে তার ঋণ শোধ হবার নয়। তিনি বলেন, আমরা প্রশাসনের তরফ থেকে কাকন বিবির স্মৃতিরক্ষায় সবধরনের কাজ করে যাব। তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবেও সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করব।
যৎকিঞ্চিৎ কাকন বিবি
দোয়ারাবাজার সংলগ্ন ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের নথরাই পাহাড়ে কাকন বিবির বাড়ি ছিল। বাবার নাম গিসো খাসিয়া এবং মায়ের নাম মেলি খাসিয়া। ৬ ভাই ১ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। মুক্তিযুদ্ধের আগে শাহেদ আলী নামের একজনকে বিয়ে করেন। তখনই তার নাম হয় কাকন ওরফে নূরজাহান। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে পাহাড়ঘেরা টেংরাটিলায় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন তিনি। সেই যুদ্ধে গুলির ছিটা লাগে শরিরে। ডান উড়–তে গুলির সেই ক্ষত অক্ষত ছিল তার। টেংরাটিলা যুদ্ধের পর আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বালিউরা, মহব্বতপুর, বেতুরা, দূর্বিনটিলা, আধারটিলা সহ প্রায় ৯টি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে রহমত আলী সহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সুনামগঞ্জ সিলেট সড়কের জাউয়া ব্রীজ অপারেশনে তিনিও চিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দোয়ারা বাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে একটি পরিত্যাক্ত কুড়েঘরে আশ্রয় নেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে তাকে এক একর খাস ভূমি প্রদান করেন। য়নের ঝিরাগাও গ্রামে সরকার প্রদত্ত জমিতে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!