স্টাফ রিপোর্টার::
সদ্যপ্রয়াত সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও গৌরারং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হেকিম তালুকদার স্মরণে ‘আব্দুল হেকিম স্মৃতিবৃত্তি পরীক্ষা’ কাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে। প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত এই বৃত্তিপরীক্ষায় গৌরারং ইউনিয়নের প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলো থেকে প্রায় ২শ শিক্ষার্থী অংশ নিবে। শুক্রবার সকাল ১০টায় জগাইরগাও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই পরীক্ষা অনুষ্টিত হবে। পরবর্তীতে এই পরীক্ষা সারা জেলা ব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন আব্দুল হেকিম তালুকদারের জ্যষ্ট সন্তান মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান।
আব্দুল হেকিম তালুদারের সংক্ষিপ্ত জীবনী
আব্দুল হেকিম তালুকদার। সদ্যপ্রয়াত এই সমাজসেবি ছিলেন ত্রিকাল দর্শী। এলাকায় একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে তিনি সুনামের অধিকারী ছিলেন। তিনি অসাধারণ কেউ নন, তবে সৎ, নির্লোভ, ন্যায়পরায়ণ, দৃঢ়চেতা ও সহজসরল এক মানুষ। প্রিয়জনদের কাছে হাকিম উল্লা ও পোষাকী নাম মো. আব্দুল হেকিম তালুকদার। ১০ জুলাই ১৯১৫ সালে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের জগাইরগাঁও গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম । পিতা মো. তোতা মিয়া তালুকদার এবং মাতা মোছাম্মৎ হাজেরা বেগম তালুকদার। টুকেরগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের শুরু এবং গৌরারং মধ্যবঙ্গ ইংরেজি (এম.ই) স্কুলে সমাপনী শেষে পারিবারিক কারণে শিক্ষাজীবনে ছন্দপতন। বড় ছেলে হিসেবে কৃষিকাজে সাহায্য করতে হয় বাবাকে, কিন্তু থেমে থাকেনি তাঁর চেষ্টা, তিন বছর পর পুনরায় ভর্তি হন তাঁর প্রিয় বিদ্যাপীঠ সরকারি জুবিলী হাই স্কুলে। সকালে হালচাষে বাবাকে সাহায্য করে, পাঁচ কি.মি. পায়ে হেঁটে সুনামগঞ্জে আসা-যাওয়া করে লেখাপড়া চালিয়ে যান তিনি। সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী হাই স্কুল থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ভাগ্য তারঁ প্রতি সুপ্রসন্ন ছিল না। তাই তিন বার প্রবেশিকা হলে প্রবেশ করেও তিনি কৃতকার্য হতে পারেননি বিধায় বাধ্য হয়েই তাঁকে শিক্ষা জীবনের ইতি টানতে হয়। তারপর শুরু তাঁর কর্মজীবন। বেছে নেন শিক্ষকতার মত মহান পেশা এবং দীর্ঘদিন জগাইরগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। গৌরারং ইউনিয়নের প্রথম চেয়ারম্যান শ্রীনগেন্দ্রকুমার চৌধুরীর মেয়াদকালে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে ট্যাক্স কালেকটরের দয়িত্ব পালন করেন।
আব্দুল হেকিম তালুকদারের দাদা খুর্শেদ তালুদার ছিলেন এলাকার বিত্তশালী এবং গণ্য-মান্য ব্যক্তিদের একজন। সবার কাছে মলই তালুকদার নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। সুনামগঞ্জ অঞ্চলে চুনের ব্যবসায় যে কয়জন সফলতা অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে মলই তালুকদার ছিলেন অগ্রগণ্য। দাদার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে ঈর্ষণীয় বিচারজ্ঞ্যান অর্জন করেছিলেন আব্দুল হেকিম তালুকদার। খুবই দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বিচারকার্য সমাধা করতেন তিনি। গ্রাম্য সালিশ-বৈঠকে তাঁর উপস্থিতি ছিল অনিবার্যভাবে অবধারিত। একই ধারাবাহিকতায় তাঁকে সিলেট জজকোর্টের জুরি বোর্ডের সদস্য মনোনীত করা হয়। সেখানেও তিনি সততা এবং দক্ষতার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে গৌরারং ইউনিয়নের প্রথম বারের মত চেয়ারম্যান এবং মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে ভাইসনচেয়ারম্যান ও আবার ১৯৮৪ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই বৎসরই সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান জয়নুল জাকেরীন বিদেশ সফরে যান। তখন আবদুল হেকিম তালুকদার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়াম্যানের দায়িত্ব অত্যন্ত সততা ও দক্ষতার সহিত পালন করেন। সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায় সমাজসেবাই ছিল তাঁর জীবনের মুখ্য ব্রত। বিচারকার্য সমাধানের স্বার্থে দিনের পর দিন গ্রামে গ্রামান্তরে রাত্রিযাপন করেছেন। এ দিক থেকে এক অর্থে, সংসারের প্রতি তিনি ছিলেন উদাসীন। আব্দুল হেকিম তালুকদার, জগাইরগাঁও সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে দুই বার এবং হাজী লাল মামুদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১২ বছর সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
এই মানুষটি ছিলেন সাধারণ মানুষদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক অসাধারণ মানুষ । ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে তাঁর বড় ছেলে মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের হাসননগরস্থ বাসায়, ১০২ বছর বয়সে এই কীর্তিমান মানুষের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে।