সেলিনা আবেদীন::
আমি দুই দফা সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছি। একবার প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালনের সুযোগ হয়েছিল। এই সময়টায় স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি নারীদের প্রতি তৃণমূলের মনোভাব খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি—আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষ নারীদের মর্যাদা দিতে শিখেছে, তারা নারীকে মানুষ হিসেবে দেখেন। কিন্তু সমাজের প্রভাবশালী কিছু গোষ্ঠী, বিশেষ করে তথাকথিত মোড়ল, ক্ষমতাবান ব্যক্তি কিংবা ধর্মীয় প্রতিনিধিদের মানসিকতা এখনও মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণায় আচ্ছন্ন।
তৃণমূলের একজন মা যখন তার মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য নিজের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের অর্থ ব্যয় করেন, অথবা একজন বৃদ্ধা যখন ইউপি সদস্যের কাছে গিয়ে নিজের প্রাপ্য ভাতার দাবি করেন—তখন বোঝা যায়, নারীরাও অধিকার সম্পর্কে সচেতন। এই নারীরা নিজেরাই প্রমাণ করেন যে তারা পেছনের সারিতে থাকতে চান না। তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করতে চান।
কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। মোড়ল সমাজ নারীর নেতৃত্ব মেনে নিতে চায় না। নির্বাচনে একজন নারী প্রার্থী দাঁড়ালেই নানা গুজব রটানো হয়, তার চরিত্র নিয়ে কটূক্তি করা হয়, কখনও ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে তার প্রচারণা আটকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় প্রচার হয়, “নারী নেতৃত্ব ইসলাম সমর্থন করে না”—যা একান্তই বিকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা। উন্নত সমাজ এসব ধারণা পোষণ করেনা।
এইসব প্রভাবশালীদের কাছে নারী মানেই অবজ্ঞার পাত্র। তারা নারীকে দেখে ‘তুলনামূলকভাবে দুর্বল’, ‘পরনির্ভরশীল’, কিংবা ‘গৃহকোণেই উপযুক্ত’ বলে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, স্থানীয় সরকারে নারী সদস্যদের অনেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছেন—গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নিয়েও কাজ করেছেন। প্র্কৃতিক দুর্যোগে, মাবিক দুর্যোগে সাহসের সঙ্গে কাজ করছেন তারা।
তৃণমূলের সাধারণ মানুষ আজ পরিবর্তন চায়। তারা চায়—নারীও তাদের প্রতিনিধি হোক, উন্নয়নের অংশীদার হোক। বিশেষ করে সমাজের বিশাল নারীগোষ্ঠীর চাওয়া এটা। কিন্তু এই পরিবর্তনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেই পুরনো মানসিকতা, যা আমাদের সমাজে প্রোথিত এক ধরনের ছদ্ম-অভিজাত্য এবং ধর্মীয় কর্তৃত্বের ধোঁয়াটে দেয়ালে বন্দী।
আমরা যারা রাজনীতিতে আসি, বা সমাজসেবায় আসি, তারা যদি সমাজের এই দ্বৈত মনোভাব ভেঙে এগিয়ে যেতে না পারি, তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন কেবল কাগজে-কলমেই থাকবে। বাস্তবতায় তার প্রতিফলন ঘটবে না।
এখন সময়—এই মনোভাব বদলানোর। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে, সহযাত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। নেতৃত্বে, উন্নয়নে, সিদ্ধান্তে—নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শিক্ষিত ও সচেতন অগ্রসর সমাজ, এবং নারীদের প্রতি সম্মানবোধ করবে।
লেখক: মানবাধিকার কর্মী, সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান, সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ।