হাওর ডেস্ক ::
নতুন বছরের ধাক্কায় কালের চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া বাইশের ১২ মাস জুড়েই বিশ্বরাজনীতিতে বুক টান করে দাঁড়িয়ে ছিল ডানপন্থিদের জয়জয়কার। শুধু ল্যাটিন আমেরিকা হেঁটেছে ভিন্ন পথে। বারবার হোঁচট খেয়েও শেষ পর্যন্ত শক্ত হাতেই উঁচিয়ে রেখেছে আদর্শের লাল ঝান্ডা। ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই অস্তাচলে ফিরিয়েছে বাম সূর্য। গেল বছর ‘গোলাপি জোয়ারে’ ভেসেছে ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ। উত্থান-পতনের খেলায় দ্বিতীয়বারের মতো ল্যাটিন আমেরিকা এ জোয়ারে গা-ভাসায়। পুনরায় ফিরিয়ে নেয় ল্যাটিনের মাটি। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, কলোম্বিয়া, চিলি, হন্ডুরাস, পেরুসহ এ অঞ্চলের প্রায় সব দেশের মানুষেরই মন কেড়েছেন বামপন্থিরা।
ADVERTISEMENT
প্রথমেই আসা যাক হন্ডুরাসের কথায়। দীর্ঘদিন ডানপন্থিদের ঘাঁটি হন্ডুরাস নিদানকালে তার বামপন্থি নেতৃত্বকেই বেছে নিয়েছে। মাদক, স্বৈরাচার কিংবা দুর্নীতির অতল গহ্বর থেকে মুক্তি পেতে দেশটির মানুষ ভরসা রাখে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট বামপন্থি শিওমারা কাস্ত্রোর ওপর। ২০২১-এর নভেম্বরে জয়লাভের পর ২০২২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি তার কার্যক্রম শুরু করেন। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের সিনিয়র বিশ্লেষক জন ক্যাভানাগ বলেন, কাস্ত্রোর জয় বামপন্থি নতুন প্রজšে§র শাসনে বিস্তৃত পরিবর্তন আনবে। তিনি জানান, বিগত পাঁচ বছরে আমরা যা দেখেছি, তা প্রগতিশীল জোয়ার। কিন্তু এটিকে আমি ‘গোলাপি জোয়ার’ বলব না। গোলাপি বলতে তিনি ঐতিহ্যগত সমাজতন্ত্রকে বুঝিয়েছেন এবং বামদের জাগরণকে তিনি ভিন্ন বিষয় হিসাবেই বিবেচনা করছেন। এতে নারীবাদী জোয়ার আছে বলেও তিনি মনে করছেন।
বছরজুড়ে আলোচনার শীর্ষে ছিল ব্রাজিলের নির্বাচন। কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে ক্ষমতায় থাকা কট্টর ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো ও বামপন্থি লুইস ইনাসিও লুলা দ্য সিলভার। অক্টোবরের নির্বাচনে জয়ের মুকুট ছিনিয়ে নেন লুলাই। এর আগেও ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘদিন ব্রাজিল শাসন করে ৭৭ বছর বয়সি বামপন্থি এই প্রেসিডেন্ট। সেসময় গোলাপি জোয়ারের প্রথম জাগরণ হয়। ল্যাটিন অঞ্চলের স্থিতিশীল এবং ধনী দেশগুলোর মধ্যে একটি চিলি। দেশটির সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হয়েছেন গ্যাব্রিয়েল বোরিক। সাবেক এই ছাত্রনেতা ২০২১-এর ১৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অতি ডানপন্থি প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে ভোটে এগিয়ে ছিলেন। এর আগে তিনি সরকারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ২০২২-এ চিলি শাসন করেছে ৩৫ বছর বয়সি বোরিক। তিনি বৈষম্য কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নিকারাগুয়ায় ৭৬ বছর বয়সি ড্যানিয়েল ওর্তেগা নভেম্বরে টানা চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হন। শপথ নেন ১১ জানুয়ারি। যদিও অনেক পর্যবেক্ষক অবাধ বা সুষ্ঠু নয় বলে সমালোচনা করেছেন। ‘পিঙ্ক টাইড’খ্যাত এই গোলাপি জোয়ার দ্বিতীয় ধাপে শুরু হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকায়। সূচনা হয়েছিল একুশ শতকের শুরুতে। নব্য উদারতাবাদ নীতি থেকে সরে বামপন্থি বিশ্বাস করতে লাগল ল্যাটিন আমেরিকা। বামদের এই জাগরণের নামই ‘গোলাপি জোয়ার’। যার পথ চলা ভেনেজুয়েলার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের হাত ধরে। শ্যাভেজ, ব্রাজিলের লুলা এবং বলিভিয়ার ইভো মোরালেসকে বলা হয় গোলাপি জোয়ারের ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’। হুগো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ১৯৯৮ সালে। লুলা ২০০৩ সালে। আর ২০০৬ সালে নির্বাচিত হন বলিভিয়ার ইভো মোরালেস। এছাড়া প্রথম ধাপে গোলাপি জোয়ারের তৎকালীন নেতা ছিলেন চিলির রিকার্ডো লাগোস, আর্জেন্টিনায় নেস্টর কির্চনার, ইকুয়েডরে রাফায়েল কোরেয়া, উরুগুয়ে তাবারে ভাস্কেজ। ২০০৫ সালের মধ্যে পুরো ল্যাটিনই ভাসছিল গোলাপি তরঙ্গে। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্থান-পতন সর্বজনিন। পরের দশকেই যেন গোলাপি জোয়ারে ভাটা পড়ে। এর কারণ ছিল সঞ্চয় কমে যাওয়া ও রপ্তানির বাজারে কম মূল্যের কারণে ব্যবসায়িক ধস। তবে ল্যাটিনরা পুনরায় গোলাপিদের জাগরণ ঘটাচ্ছেন।