বিশেষ প্রতিনিধি::
হাওরের ফসলহানীর ঘটনায়ী দুর্নীতির অভিযোগে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে গত রবিবার মামলা দায়েরের পর অভিযুক্ত পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) বিরুদ্ধেও মামলা দায়েরের দাবি উঠেছে সুনামগঞ্জে। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ নানা ফোরামে-আলোচনায় যেসব পিআইসি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য দুদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। হাওরের ফসলহানীর ঘটনায় দুর্নীতির অভিযোগে কেবল সুনামগঞ্জের পাউবো ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে মামলার পাশাপাশি অন্য জেলার হাওরের ফসলহানীর ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
কৃষকরা জানান, গত ২৯ মার্চ থেকে সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল বাঁধ ভেঙ্গে, যথা সময়ে বাঁধ না দেওয়ার কারণে এবং শেষ দিকে বাঁধ উপচে জেলার প্রায় দেড় শতাধিক হাওরের সম্পূর্ণ বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। একই সময়ে সিলেট, মৌলভী বাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণার হাওরেরও একমাত্র ফসল আগাম তলিয়ে যায়। সরকারি হিসেবে ৬ উপজেলায় প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার ৮৮ কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাওরের একমাত্র ফসল তলিয়ে যাওয়ায় সরকার এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে ৬ জেলার প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার কৃষককে তিন মাসের বিশেষ ভিজিএফ (৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা মাসিক) প্রদান করছে। সরকারি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুনামগঞ্জ। এই জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির মধ্যে সরকারি হিসেবে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাড়ে ৩ লাখ কৃষক পরিবারের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার কৃষক পরিবার। ফসলহানীর ঘটনায় এলাকাবাসী পাউবো, পিআইসি ও ঠিকাদারদের দায়ি করে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন-বিক্ষোভ সমাবেশ-সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন কৃষক-জনতা। তবে একটি মহল কেবল ঠিকাদারদেরই বিচার দাবি করে আসছিল।
কৃষক ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ১৫ ডিসেম্বর হাওরের ফসলরক্ষা বাধের কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই সময়ে ২০ ভাগ কাজও হয়নি। কষকদের মতে মার্স মাস পর্যন্ত প্রায় ৫০ ভাগ কাজ হলেও পাউবোর হিসেবে মতে ওই সময় পর্যন্ত ২০১৬ অর্থ বছরের ঠিকাদারদের ৮৪ টি প্যাকেজের বিপরিতে কাজ হয়েছিল ৮০ ভাগ। এই বছরের ২৮টি প্যাকেজের মধ্যে ওই সময়ে কাজ হয়েছে ৭০ ভাগ। চলতি বছরের দ্বিতীয় দফার ৪৮ টি প্যাকেজে কাজ হয়েছিল ৫০ ভাগ। গত বছরের এবং এ বছরের কোন কাজই শতভাগ হয়নি পাউবোর রিপোর্ট মতে। এই কারণেই ফসলহানীর ঘটনা ঘটে বলে কৃষক ও স্থানীয়দের অভিযোগ। এদিকে সুনামগঞ্জে এ বছর পিআইসিকে প্রায় ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। তাদের অনেকেরই বিরুদ্ধে নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তারা ধরা ছোয়ার বাইরে রয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।
জানা গেছে ফসলহানীর পরই স্থানীয় কৃষক ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা আগাম ফসলহানীর ঘটনায় পাউবো, পিআইসি ও ঠিকাদারদের দায়ি করে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। এ ঘটনায় সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করে। পরে সরকার দুদককে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়। শেষ পর্যন্ত গত ২ এপ্রিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৫ কর্মকর্তা ও ৪৬ জন ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করে দুদক। এই মামলায় পিআইসির কাউকে আসামী না করায় এবং অন্য জেলার পাউবো ও ঠিকাদারদের আসামী না করায় প্রশ্ন দেখা দেয়। বিশেষ করে অন্য জেলার ঠিকাদার-পাউবোর কর্মকর্তা ও পিআইসিদের মামলায় যুক্ত না করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। যার এখনো অব্যাহত রয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্র লীগ নেতা পাভেল আহমেদ বলেন, সরকার সুনামগঞ্জসহ ৬ জেলার কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। একই কারণে একই সময়ে ফসলহানীর ঘটনা ঘটলেও কেবল সুনামগঞ্জের পাউবো ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে মামলা করায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা দুর্নীতিবাজ পিআইসি ও অন্য জেলার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও মামলা চাই।
সদর উপজেলা যুবলীগের সদস্য ফয়সাল আহমেদ বলেন, কেন শুধু সুনামগঞ্জের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামল হলো। তিনি বলেন, অনেক পিআইসি দুর্নীতি করেও রেহাই পেয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করা উচিত।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী সিদ্দিকা বলেন, পিআইসিকে ছাড় দেওয়ায় অনেক দুর্নীতি আড়ালে থেকে যাবে। তারা বাদ পড়লে মি. ২০ পার্সেন্টদের বের করা যাবেনা। তিনি পিআইসির বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য ঠিকাদারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
দুদকের পরিচালক ও হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের দুর্নীতি অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও মো. বেলাল হোসেন বলেন, সরকার আমাদেরকে শুধু সুনামগঞ্জ জেলার হাওরের ফসলরক্ষা বাধের দুর্নীতি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছে। এ জন্য আমরা শুধু সুনামগঞ্জের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করেছি। তাছাড়া পিআইসির অভিযোগেরও তদন্ত শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান। সরকার যদি অন্য জেলার হাওরের ফসলরক্ষা বাধের কাজের দুর্নীতির তদন্তের দায়িত্ব দেয় তাহলে আমরা একই ব্যবস্থা নেব।