স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। সেই কৈশোরে, ১৯৬৮ সনে, যখন আমি সুনামগঞ্জ আসি তখন যেমন জানতাম না এই সুনামগঞ্জেই আমি থিতু হবো, তেমনি জানতাম না একদিন এই ‘পাবলিক লাইব্রেরি’র সহসভাপতি হয়ে পড়বো। আমরা সেই সময়ে ‘পাবলিক লাইব্রেরি’ই বলতাম। এখন এই লাইব্রেরির নাম হয়েছে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরি’। এই নামায়ণের অবশ্য ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত একটি ইতিকথা আছে। নামায়ণের এই বিবর্তনের ইতিহাস এক অর্থে চমকপ্রদ না হলেও সামাজিক চিৎপ্রকর্ষের সংঘাতের বৈচিত্র্যটি তাতে মূর্ত হয়েছে, এ দিক থেকে এই নামায়ণের তাৎপর্যকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। বারান্তরে সেটা বর্ণনা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না, তবে আশা প্রকাশ করছি, যদি অবকাশ মেলে। আজ কেবল এই কথা বলে রাখি যে, এই নামকরণের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চেতনা এবং নামের সঙ্গে বিশেষ স্পর্শকাতর শব্দ ব্যবহারের আপত্তি ইত্যাদির মিথষ্ক্রিয়াজাত অদ্ভুত বিপত্তিজনক প্রপঞ্চ বিদ্যমান।
এই পাঠাগারটিতে একদিন সেই দুরন্ত কৈশোরে এসে বই পড়তাম। একটি লাল ডেউটিনের দু’চালা ঘর। উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত। পূর্ব দিকে ঘরের মুখ। দক্ষিণে থানা, পূর্বে মহকুমা প্রশাসকের বাড়ি, উত্তরে জেলখানা ও জেলখানার পশ্চিমে লাগোয়া হাসপাতাল, পশ্চিমে কচুরিপানা ভর্তি পুকুরের সবুজচত্বর। থানার সামনা থেকে উত্তরে জেলখানার (এই জেলখানা আর জেলখানা নেই। এখন এটি সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের আবাসিক ছাত্রীনিবাস।) সামনা দিয়ে প্রলম্বিত সড়ক গিয়ে মিশেছে নদীর পাড়ের বাজারের রাস্তায়। থানার সামনা থেকে শুরু এই রাস্তার শুরুতেই পশ্চিমের একচিলতে সবুজ ঘাসে ঢাকা উঠোন তার পরেই পাঠাগারের ভবনের, সম্ভবত ঠিক মনে পড়ছে না, দু’ধাপ পাকা সিঁড়ি। দেবদারু গাছের নীচে এই সিঁড়িতে বসে চলতো জম্পেশ আড্ডা, যখন তখন, এমনকি রাতেও।
কাঠের আলমিরার তাকে সাজানো বই। পাওয়ারি চসমা চোখে মনোরঞ্জনদা। বুড়ো মানুষ। পাঠাগারের সর্বেসর্বা। পাঠাগারের ভেতরে তাঁর শাসন ছিল কড়া। আমি কেন জানি না, প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম তাঁকে। বই চাইতে গিয়ে বুক কাঁপতো। কীছু কীছু বই ছিল যে-গুলো কীছুতেই তিনি কমবয়েসীদেরকে দেবেন না। চাইলে রীতিমতো ধমক লাগাতেন। পরে অবশ্য আমার সাথে তার খুব সখ্য হয়েছিল। সে সখ্যর সৌরভ এখনকার কমবয়েসীরা কোনও বুড়ো মানুষের কাছ থেকে পায় কি না জানি না। তাঁর অসাধারণ একটা গুণ ছিল। ভাবতাম কী করে তা সম্ভব। কোনও একটি বইয়ের নাম বললেই তিনি পাঠাগারে বইটির ঠিকানা বলে দিতে পারতেন। কোন আলমিরার কোন তাকে উর্দিষ্ট বইটি পাওয়া যাবে সব ছিল তার নখদর্পণে। কোনও কোনও বইয়ের বেলায় তাকের মাঝখানে কিংবা ডান অথবা বাঁ কিনারায় বইটির অবস্থান, তাও তিনি বলে দিতে পারতেন। আজ মনে হয়, বিষয়টি ছিল অনেকটা রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সেই গানের কলি ‘কেমন করে গান করো হে গুণী’-র মতো ‘কেমন করে বই খোঁজ হে গুণী’র মতো অবাক করা। মনোরঞ্জনদার সঙ্গে পাঠাগারে ছিলেন আরও একজন। তিনি লাব্রেরিয়ান। বয়স্ক মানুষ। সৌম্যদর্শন। প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যাওয়ার মতো লম্বা একহারা এক ধীরস্থির আদমছুরত। তিনি সুনামগঞ্জে বাম রাজনীতিক বলে পরিচিত সালেহ ভাইর (আ. ত. ম. সালেহ) পিতা। পাঠাগরে গেলে তাঁর সাথে দেখা হয়েছে, প্রায় নিত্য দিন, কিন্তু কোনও দিন কথা হয়নি কখনও।
উত্তরে চিলে কোঠার মতো একটি ঘর ছিল। সেখানে কটি চেয়ার তৎসঙ্গে একটি আরামকেদারা পাতা। শহরের শ্রেষ্ঠ সম্ভ্রান্তজন এখানে বসে পড়াশোনা করতেন। এই চিলেকাঠা আমার মতো কম বয়েসী কিংবা লেতিপেতিদের জন্য নয়, বিশিষ্টজনদের জন্য ছিল নির্দিষ্ট করা। অর্থাৎ সেখানে সকলের প্রবেশের রেওয়াজ ছিল না। আব্দুল হাই (হাছন পছন্দ), ওবায়দুর রেজা চৌধুরীর মতো বিদ্বৎজনেরা আসতেন, বসতেন এখানে। সকলকে চিনতাম না, নামও বলতে পারবো না।
সুনামগঞ্জের কবিতান্দোলনের পুরোহিত কবি মুতাসিম আলীর পাল্লায় পড়ে আমাকে ছন্দ শিখতে হয়েছিল। এই পাঠাগারে বসেই রাবীন্দ্রনাথের ছন্দ বইটি পড়েছিলাম নিতান্ত কাঁচা বয়েসে। তখন বলতে গেলে কীছুই বুঝিনি। কিন্তু পড়েছিলাম খুব মনোযোগ সহকারে। নোট নিয়েছিলাম দেদার। পরে এই না বুঝে পড়া নোটগুলোই খুব কাজে লেগেছিল, ছন্দকে সুগভীরভাবে আত্মস্থ করতে। তখন মুতাসিমের পৌরহিত্যে এই পাঠাগারে অনেক অনেক সাহিত্যসাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়েছেন এ শহরের সাহিত্যসাংস্কৃতিক কর্মীরা। এক সময়ের সাহিত্যসাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আমরা কতিপয় তরুণ সাহিত্যসেবী’ ও পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’-এর পতাকা বাহকদের তীর্থস্থান ছিল এই পাঠাগার। মুতাসিমের খেয়াল হলো স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস, বিজ্ঞান ও দর্শন সম্পর্কে সম্যক অবহিতকরণ প্রয়োজন। তাঁর ধারণা এই কটি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিক্রিয়াশীলতাকে পরিপুষ্ট করে, দুনিয়াকে দেখার চোখ খোলে দেয় না, বরং চোখে একরধরণের পর্দা তৈরি করে, প্রকারান্তরে অন্ধ করে তোলে, লোকে চোখ থাকতেও কানা হয়ে যায়। এই পাঠাগারেই এলো ছাত্রছাত্রীরা। এই পাঠাগারই প্রয়োজনীয় বই সর্বরাহ করলো আমাদেরকে। পাঠদানের প-িতি আমাকেই দেখাতে হলো মুতাসিম নির্দেশিত কাঠখোট্টা বই পড়তে পড়তে। এতে অবশ্য একটি লাভ আমার হয়েছিল। আমার চোখের সামনে দুনিয়া দেখার অন্যরকম দরজা খোলে গিয়েছিল। উন্মোচিত হয়েচিল মুক্তবাজার অর্থনীতির হরেক রকমের কেরদারিসমা। এতো কীছুর পর অন্তত এইটুকু জেনেছিলাম যে, অর্থনীতিই ইতিহাসের চালিকাশক্তি।
এই পাঠাগারে মাঝেমাঝেই সাহিত্যসংক্রান্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান, যেমন কবিতাপাঠের আসর কিংবা বিশেষ কোনও বিষয়ে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হতো। এখানেই একবার লেখক শিবিরের আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন, ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’র কথাকার বিখ্যাত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। আলোচনার বিষয় ছিল, ‘বাংলা সাহিত্যে প্রতিবাদের ধারা’ । প্রবন্ধটি প্রতিস্থাপন করেছিলেন, রজতকান্তি সোম মানস। তিনি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন না। উদ্ভিদ নিয়ে ¯œাতকোত্তর উপাধি অর্জন করেছিলেন। সেদিন আখতারুজ্জান ইলিয়াসের একটি অবিস্মরণীয় ভাষণ শ্রবণ করেছিলাম। সুনামগঞ্জের নির্দিষ্ট আলোচকেরা প্রত্যেকেই মানসের উপস্থাপিত মতামতকে সমর্থন করতে পারেননি। যেমন : মানস রবীন্দ্রনাথকে বিপ্লবী বলে ফেলেছে, কিন্তু আলোচকদের মতো রবীন্দ্রনাথ যে-কোনও বিবেচনায় বর্জোয় ও প্রতিক্রিয়াশীল। তাঁরা কঠোর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন এবং আক্রমণ শানিয়েছিলেন বীভৎসভাবে। কিন্তু ইলিয়াস নির্দ্বিধায় সমর্থন করেছিলেন মানসকে এবং তুলো ধুনা করেছিলেন সুনামগঞ্জের আলোচকদের। তিনি বলেছিলেন, ‘আজকে ছাড়া যায় না।’ মনে মনে খুব রেগে গিয়ে ছিলেন বলেই মনে হয়। এই পাঠাগারে একময় এমনসব চমকপ্রদ কা-কারখানা হতো। আসলেই এই পাঠাগার আমাদের সেদিন তৈরি হওয়ার জায়গা দিয়েছিল। আমরা কতিপয় তরুণ সাহিত্যসেবী এই পাঠাগারকে জীবনতীর্থের মহড়াস্থল করে নিয়েছিলাম। এই তরুণ সাহিত্যসেবীদের মধ্যে ছিলেন মুতাসিম আলী, মানিক লাল রায়, অজিতকুমার দাস, জীয়নকুমার দাস মিন্টু, মোহাম্মদ সাদিক, মমিনুল মউজদীন, রোকেস লেইস, লুৎফার রহমান শামীম, হাসান আফরোজ প্রমুখ। এখন ভাবি তখনকার ছন্নছাড়া জীবনটা কী বিখ্যাত ছিল। বেহিসেবী বোহেমিয়ান জীবনের স্মৃতিবিস্মৃতির কতো ছবি কতো গানের সুবর্ণ কোলাজ এই পাঠাগার।
জীবনকে যে-পাঠাগার অনায়াসে বদলে দিতে পারে, কতো প্রবল প্রতাপী সে, আমাকে বদলে দিয়েছে অন্যরকম করে। জীবনের তীর্থক্ষেত্র সেই পাঠাগারের সহসভাপতি হয়ে পড়ব, কোনও দিন ভাবিনি, জীবনের চলার পথে এমন অমিয় স্বপ্নে বিভোর হওয়ার কোনও অবকাশও মেলেনি। এই হয়ে পড়ার পেছনে নিজের ভেতর থেকে স্বপনময় কোনও ইচ্ছার উদ্রেক নেই, বলতে গেলে, এমনকি নিজের তেমন কোনও সচেতন প্রয়াসও নেই। এই হয়ে যাওয়া এমনি এমনি হয়ে যাওয়ার মতো একটি হয়ে যাওয়া, এর বেশি কীছু নয়। একটু কৌতুকী বাক্যবাতাবরণ তৈরি করে বললে বলতে হয়, আসলেই আমি একটি ‘ষড়যন্ত্রের শিকার’। ষড়যন্ত্রটা করেছেন আমারই ¯েœহাস্পদ ছাত্র উকিল ও সাংবাদিক খলিল রহমান। তিনি ইদানিং দেখছি নাটকও রচনা করেন। তিনি আর লোক পেলেন না, পাঠাগারের রাজনীতির বলির পাঠা করলেন আমাকেই। হঠাৎ সাক্ষাতের বিনয়াবনত নিবেদন, অনন্তর অনুরোধে ঢেঁকি গলাধঃকরণ। আগেই বলে দিয়েছিলাম, প্রচারণার কাজে নামতে পারবো না। ভোট চাইতে যাবো না। খলিল তাতেই রাজি। কী আর করা। সুনামকণ্ঠের সম্পাদক বিজন সেনরায়, আর এক নাছুঁড়বান্দা রায়। দাঁড়িয়েছি জানতেই তিনি আমাকে নিয়ে ভোটযুদ্ধে নেমে পড়তে এক পায়ে খাড়া। তাঁর পীড়াপিড়িতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁর ও আমার প্রিয় বেশ কজনের দ্বারস্থ হতেই হলো ভোটভিক্ষাহেতু। এই পর্যন্তই নির্বাচনী প্রয়াস। পরিণতিতে সতীর্থবন্ধু (কানে কানে বলি, রাবিদায় তিনি আবার আমার শ্বশুর বটেন) মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের পিছু ধরে একেবারে সহসভাপতি হয়ে পড়লাম এবং বুঝতে পেরেছি,এই হয়ে পড়াটা এমনি এমনি হয়ে যায়নি। আমি তেমনভাবে কারও কাছে ভোটভিক্ষা করিনি। যাঁরা আমাকে ভোট দিয়েছেন, সতিকার অর্থেই তাঁরা আমার শুভার্থী ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। আমি সকল ভোটার ও শুভার্থীদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। অনেকেই ভোটার নন কিন্তু আমি তাঁদের প্রিয়ভাজন বলে ভোটারদেরকে আমাকে ভোট দিতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁদেরকেসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। ভোট চাইতে আপনাদের কাছে যেতে না পারার আমার অপারগতাকে ক্ষামাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবনে, এই আশা করি। আমাকে নিয়ে এই নির্বাচনী নাটক রচনা করার জন্য খলিলকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করবো না, তিনি জীবনের নন্দনকাননের অধিবাসী হোন, এই কামন করি। আর নির্বাচনপ্রেমী বিজনদার শ্রীকরকমলে নিবেদন করি প্রীতিপুষ্পের আন্তরিক উপহার।
সতীর্থবন্ধু মালেক হুসেন পীরের বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ ছিল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার। তিনি আবু সুফিয়ানের সেঙ্গ নির্বাচনী কাজে তখন যারপরনাই তৎপর। কিন্তু দুয়েক দিন পর এসে বললেন, আবহাওয়া নাকি অন্যরকম, প্রত্যহার না করাই ভালো। অমৃতবচন বর্ষিত হলো, ‘তুই বসে থাক।’ পীরহুজুরের পবিত্র বাণী সাকরেদের অমান্য করার জো থাকে না। সুতরাং তাথাস্তু। তখন মনে ভাবনার সূর্যোদয় হয়েছে : পাঠাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়েছে ১৯৭১-য়ের পরবর্তী সময়ে এবং এবারের এই নির্বাচন সে দ্বন্দ্বের পরিপক্কতাকে প্রতিভাত করেছে, যে-দ্বন্দ্বটির একটি ক্রমবিকাশ আছে, এখানে সে-লম্বা বয়ান হাজির করার অবকাশ নেই। সংক্ষিপ্ত বয়ানে কেবল বলা যায়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, প্রতিটি আর্থসামজিক স্তরের ভেতরে, সাংস্কৃতিক পরিসরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে একটি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলতা। এই দ্বন্দ্বের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া নির্বাচনে ইকবাল কাগজী কিংবা আবু সুফিয়ানের মতো অনাকাক্সক্ষীর প্রার্থিতা নিশ্চিত করেছে, খলিল কিংবা তার পেছনে সালেহ আহমদের মতো কেউ যদি থাকেন তাঁরা এই কথিত দ্বন্দ্বের ক্রীড়নক মাত্র। পাঠাগার রাজনীতির ক্ষেত্র নয়। পাঠাগারে লোকেরা প্রবেশ করে জ্ঞানার্জনের জন্য কিংবা চিৎপ্রকর্ষের কাজ অব্যাহত রাখার জন্যে। আমাদের রসুলের (স.) নির্দেশ, জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনে গমন করো। সুনামগঞ্জের মানুষ জ্ঞানার্জনের জন্য চীনে না গিয়ে এই পাঠাগারে যায়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, পাঠাগার সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে যতোটা গুরুত্ববহ রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রে ততোটা গুরুত্ববহ নয়। কিন্তু এই নির্বাচন প্রমাণ করে দিয়েছে যে, সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রাজনীতি এবং রাজনীতি সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস চালাতে পারে। একে বলে, অংশের দ্বারা সমগ্র নিয়ন্ত্রিত হওয়া। অংশের দ্বারা সমগ্রের নিয়ন্ত্রণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো : এক ফোঁটা চোনা এক বালতি দুধকে নষ্ট করে দেয়। বাস্তব অবস্থা বলে দিচ্ছে পাঠাগারে সে-নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি তৈরি হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পাঠাগারের এমনসব দাতাসদস্য ও আজীবন সদস্য (যাঁরা পাঠাগারর কার্যকরী পর্ষদকে নির্বাচন করেন) সংগ্রহ করা হয়েছে, যারা প্রকৃতপ্রস্তাবে পাঠাগারভিত্তিক সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে জড়িত নন, হয় তো জীবনে কখনও কোনও বইই পড়েননি বা পড়তেই জানেন না। জনশ্রুতি আছে, এই পাঠাগারে এমন আজীবন সদস্য আছেন যিনি টিপসই দিয়ে সদস্য হয়েছেন। একেবারেই স্পষ্ট যে, এমন টিপসইওয়ালা আজীবন সদস্য পাঠাগারের কোনও সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করতে পারবেন না, কেবল নিশ্চিতভাবে পারবেন একটি ভোট দিতে। এইরূপ সদস্য সংগ্রহের কোনও না কোনও একটি উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে, এমনটা ভাবতেই পারেন যে-কেউ এবং সে ভাবনাটি একেবারে অমূলকও বিবেচিত হবে না, বোধ করি। এই বাড়তি প্রয়াসটি চালানো হয়েছে কার্যকরি পর্ষদে ক্ষমতা নিশ্চিত করার অভিপ্রায়ে অর্থাৎ কার্যকরি পর্ষদের নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। সুতরাং পাঠাগারের কার্যকরী পর্ষদের নির্বাচকম-লির পরিমাণগত বিশেষ পরিবর্তনটি নির্বাচকম-লির একটি গুণগত পরিবর্তনও সাধিত করেছে। এই গুণগত পরিবর্তন পাঠাগারের নির্বাচনকে করে তোলেছে অধিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাশঙ্কুল এবং নির্বাচনের স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক আবহের অভ্যন্তরে রাজনীতি হয়ে পড়েছে নিয়ন্ত্রক। এই দ্বান্দ্বিকতার চাপে পড়ে কিংবা বলা ভালো রাজনীতিক কূটচালের শিকার হয়ে সমাজে নিরঙ্কুশ সম্মানের অধিকারী বিদ্বজ্জন নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার স্বাভাবিক সম্মানজনক পদ্ধতিটির অপনোদন ঘটেছে। মানবসৃষ্ট এই অবিমৃষ্যকারিতা থেকে উদ্ভূত নিয়তিটিকে টেনে যেতে হবে এই পাঠাগারকে অনেক অনেক দিন পর্যন্ত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সাময়িক ব্যক্তিক স্বার্থপরতা সামাজিক পরার্থপরতাকে এভাইে বরাবরের মতো পরাভূত ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বৈষম্যনির্ভর সমাজের প্রগতি ও প্রতিপ্রগতির দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত এই আর এক অনিবার্য নিয়তি, বিপ্লবের বিপরীত প্রপঞ্চ প্রতিবিপ্লবের উদ্ভব। কেবল একটি সাধারণ পাঠাগারের ক্ষেত্রে নয় বরং সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে এই প্রপঞ্চের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়, প্রতিনয়ত। লেখক শিবিরের কথা উপরে উল্লেখিত হয়েছে। সংগঠনটি ছিল পরিপূর্ণভাবে সাংস্কৃতিক। মূলত সাহিত্যসংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনরা ছিলেন এই সংগঠনটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু এটিকে রাজনীতিক সংগঠনে পরিণত করার লক্ষ্যে শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদেরকে (যাঁরা সাহিত্যসংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ নন) সংগঠনটিতে অনুপ্রবেশ ঘটানোর প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং প্রকারান্তরে অচিরেই সংগঠনটি ভেঙে পড়ে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ ঘটেছে বই পোকা নয়, এমন কি শোনা যায় পড়তে জানে না এমন, আজীবন সদস্যগণের। এবংবিধ অনুপ্রবেশ প্রক্রিয়া পাঠাগারের নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে অমসৃণ, জটিল ও অসঙ্গতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাশঙ্কুল করে তোলেছে এবং এই পরিস্থিতির বদল হতে গঙ্গাযুমনার পানি অনেক দূর গড়াবে। পাঠাগারের মতোই সমগ্র সমাজে বিদ্যমান এই সমাজবাস্তবতকে বর্ণনা করা যায় ১৯৭১-য়ের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আবির্ভূত সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চের বিপরীত প্রপঞ্চ বিস্তারের প্রাণান্ত প্রয়াস রূপে এবং স্বাভাবিকভাবেই একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আলোচ্য পাঠাগারটি সে-প্রয়াসের বহির্ভূত হয়ে যেতে পারে না এবং বাস্তবে তা-ই পরিলক্ষিত হচ্ছে।