1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৪:৫৫ অপরাহ্ন

অনুকরণীয় জীবনের অধিকারী একজন গোপেশ মালাকার|| সুশান্ত দাস(প্রশান্ত)

  • আপডেট টাইম :: শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৩, ৬.৫৬ এএম
  • ৬৪ বার পড়া হয়েছে

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যিনি যুদ্ধ করেছেন তুলি দিয়ে,রং-এর অঙ্কনে ফুটিয়ে তুলেছেন মুক্তির আকাঙ্খা
তিনি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম সদস্য,বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্র শিল্পী গোপেশ মালাকার। যিনি কলম,কালি,তুলিতে এক অনন্য মাল্যবর। ছিলেন এদেশের একজন ভেটারেন কমিউনিস্ট।

পারিবারিক জীবনে স্ত্রী এডলিন মালাকার সহ ২পুত্র ২নাতি রয়েছে। তাদের বসবাস আমেরিকা ও কানাডায়। গোপেশ মালাকারের জন্ম ১৯২৮ সালের সুনামগঞ্জের ছাতক পৌরসভার বাগবাড়িতে। পিতা গুরুচরণ মালাকারের পুত্র গোপেশ মালাকার। তাছাড়াও তাঁর উমেষ মালাকার ও প্রভাষিনী মালাকার নামে এক ভাই ও এক বোন রয়েছে।

গোপেশ মালাকার’র গল্প প্রথম শোনা মুক্তিযুদ্ধ গবেষক তাজুল মোহাম্মদ হতে। যাঁর জীবন হেমাঙ্গ বিশ্বাস,শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন,কামরুল হাসানের মতো আলোয় প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছিল। যাকে বঙ্গবন্ধু নিজে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি লাভের সময় অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।

তাঁর জীবন কর্ম হতে জানা যায় শিক্ষকতা করেছেন চারুকলাতে। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে আয়ুব খান তাঁকে চারুকলার শিক্ষকতা থেকে চাকরিচ্যুত করেন।
দেশ স্বাধীন হলে চারুকলাতে আবার চাকরিতে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পাকিস্তানি ধারা প্রবর্তন হয়ে আয়ুবের ন্যায় প্রেসিডেন্ট জিয়া একই কায়দায় আবার চাকরিচ্যুত করেন। অতঃপর একটি এনজিওর কর্তা হয়ে ওঠলেন। চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেখান থেকেও অপসারণ করার উদ্যোগ নিলে গোপেশ মালাকার পদত্যাগ করে দেশের বাইরে চলে গেলেন।

গোপেশ মালাকার পড়াশোনা করেছেন ছাতক স্কুলে। ক্লাস তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘কিশোর বাহিনী’তে জড়িয়ে পড়েন। অতঃপর ১৯৪৭ ইংরেজিতে মেট্রিক পাস করেন। সে সময়ে ‘মুকুল ফৌজ’ নামেও একটি শিশু-কিশোর সংগঠন থাকলেও ৩ টি ছাত্র সংগঠন ছিল। ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র কংগ্রেস ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন। তিনি ছাত্র ফেডারেশন করতেন। জনসংযোগের অংশ হিসেবে ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য গোপেশ মালাকার ছবি আঁকা,পোস্টার লেখা ও নাটকে অংশ নিতেন।

(২)
ইংরেজি ১৯৪৩ সাল; বাংলায় ১৩৫০ বঙ্গাব্দ। ১৩৫০ বঙ্গাব্দে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে একে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বলা হয়। বিশেষ করে দুই বাংলায় দুর্ভিক্ষের করাল থাবা ছিল সবচেয়ে করুণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমানে বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারত) বাংলা প্রদেশে দুর্ভিক্ষ। আনুমানিক ২.১-৩ মিলিয়ন বা ২১ থেকে ৩০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে, অপুষ্টি জনসংখ্যা স্থানচ্যুতি, অস্বাস্থ্যকর অবস্থা এবং স্বাস্থ্য সেবার অভাবের কারণে অনাহার,ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য রোগে মারা গেছে। এর ফলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে জয়নুল আবেদীনের করা স্কেচ নিয়ে প্রদর্শনী হয়। পঞ্চাশ’র মন্বন্তরের সময় জয়নুল আবেদীনের ৩টি স্কেচ ও সুনীল জানার আঁকা ২টি ছবি দিয়ে পিকচার কার্ড ছাপানো হয়। তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশন তা বিক্রির উদ্যোগ নেয়। সিলেটেও সেই পিকচার কার্ড কয়েক হাজার বিক্রি হয়। সেসময়ে গোপেশ মালাকার বিক্রয় উদ্যোগে সক্রিয় ছিলেন। প্রায় সময় বাড়ি থেকে গেলে থেকে-যেতেন সিলেটে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে।

দেশভাগের পর গোপেশ মালাকার সর্ব-ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের ডাকে কলকাতার কাউন্সিল মিটিংয়ে অংশ নেন। এই সভায় ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ফেডারেশন দুই ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। জন্ম হয় পূর্ব বঙ্গ ছাত্র ফেডারেশনের। শহীদুল্লা কায়সার সেক্রেটারি করে পূর্ববঙ্গ ছাত্র ফেডারেশনের প্রথম অধিবেশন ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত হয়। গোপেশ মালাকার সিলেট জেলার ছাত্র ফেডারেশনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। অচিরেই ফেডারেশনের নেতাদের একে একে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকেও যেতে হয় কারাগারে। শেষ পর্যন্ত ছাত্র ফেডারেশন আর টিকতে পারেনি।

ছবি আঁকায় গোপেশ মালাকারকে উৎসাহিত করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সে সময়ে সিলেটের মফস্বলে(বিয়ানিবাজার,গোলাপগঞ্জ,বড়লেখা,কুলাউড়া,বালাগঞ্জ,ধর্মপাশা থানা, ১৮ আগষ্ট ১৯৪৯) নানকার আন্দোলন তুঙ্গে। সিলেটে এর প্রচারের দায়িত্ব পরে গোপেশ মালাকারের ওপর। নানকার আন্দোলনের প্রচারপত্র বিলি করার সময় তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হন। অতঃপর গড়েওঠে প্রথম ছাত্র ইউনিয়ন গঠনের আওয়াজ।

(৩)
৫৬’ সালের সেপ্টেম্বরে গোপেশ মালাকার জেল থেকে ছাড়া পান। কারা ফটকে এসে তাঁকে গ্রহণ করেন রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ বন্ধু নাসির। নাসিরের মাকে গোপেশ মালাকার মাসি বলে সম্বোধন করতেন। এই মাসি হলেন জয়নুল আবেদীনের শাশুড়ি।

গোপেশ মালাকারের বয়স ২৭। ভর্তি হলেন পড়ার জন্য ঢাকা গভ. আর্ট ইনস্টিটিউটে। জেলখানায় মনকে চাঙা রাখার জন্য কাঠ-কয়লা দিয়ে দেয়ালে বিদ্রোহের ছবি আঁকতেন তিনি। সেসময়ে কোনো ছাত্র সংসদ ছিল না; কিন্তু একটি ছাত্র কমিটি ছিল। তিনি ছাত্র কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। সেসময় আর্ট ইনস্টিটিউটকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হতো।

১৯৫৮ সাল। আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। উক্ত স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কর্মসূচি নেওয়ার জন্য আর্ট ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরাও রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে পরিকল্পনা শুরু করেন। এ কাজে নেতৃত্ব দেন শিল্পী জয়নুল আবেদীন ও কামরুল হাসান। এই বছর সিদ্ধান্ত হয় বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে বড় আকারে একটি প্রদর্শনী করা হবে ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে। গোপেশ মালাকার প্রদর্শনী কমিটির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়ে আয়োজিত হয় এই প্রদর্শনী; যা দর্শক ও বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আন্দোলিত করে। ঐ বছর প্রথম ইনস্টিটিউটের বকুল তলায় সভার আয়োজন করা হয়। এই ৫৮’র চারুকলা প্রদর্শনীর পরের বছর থেকে আলপনা আঁকার ঐতিহ্য আর্ট ইনস্টিটিউটের চৌহদ্দি পেরিয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পৌঁছায়। এভাবেই চারুকলা ইনস্টিটিউট বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়।

চারুকলায় তাঁর নামে চালু করেছেন গোপেশ মালাকার এওয়ার্ড। ছাত্রজীবন হতে ছবি আঁকা,পোস্টার লেখা ও নাটকে সম্পৃক্ত হলেও বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পেও রয়েছে তাঁর অনন্য ভূমিকা। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের সময়কালকে যদি বাংলাদেশের প্রচ্ছদের আদি যুগ ধরা হয় তাহলে দেখা যায় শিল্পীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র।এদের মাঝে গোপেশ মালাকারের নামও উল্লেখযোগ্য। তাছাড়াও এখন পর্যন্ত তিনি বিয়াল্লিশটি বই লিখে গিয়েছেন।

উল্লেখ্য গত ১৯ এপ্রিল বুধবার সকাল ৮:৪০ মিনিটে কানাডার ব্রাম্পটনের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৯৬ বছর। নতুন প্রজন্ম এই অনুকরণীয় জীবনের অধিকারী মানবতাবাদী বিপ্লবীর কর্ম ও চিন্তাকে অনুস্মরণ করবে।
#
লেখকঃ সুশান্ত দাস(প্রশান্ত)
রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিককর্মী
লন্ডন,যুক্তরাজ্য।

ইমেইল- sushantadas62@yahoo.co.uk

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!