1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫২ পূর্বাহ্ন

বিষ্মৃতির অতলে অনন্য মুক্তিযোদ্ধা শ্রীকান্ত দাস।। রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু

  • আপডেট টাইম :: বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৯, ৫.০৭ পিএম
  • ৩৫৭ বার পড়া হয়েছে

রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু ::
সুনামগঞ্জের বৈশেরপাড় যুদ্ধে শহীদ হওয়া শ্রীকান্ত দাস যুদ্ধের পর যার বীরশ্রেষ্ঠ হওয়ার কথা কিন্তু জোটেনি সর্বনিম্ন পদক বীরপ্রতীক পদকটিও। ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর সুনামগঞ্জের ভৈষারপাড় সম্মুখ যুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা শ্রীকান্ত দাস পাক বাহিনীর গুলিতে যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যান। পাক বাহিনীর গুলি তাঁর শরীরে লেগে শরীর ঝাঝড়া হয়ে যায়। শ্রীকান্তের নিথর শরীর রাস্তায় পড়ে থাকার পরও পাক বাহিনী ক্ষান্ত হয়নি। বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে শ্রীকান্তের দেহ থেকে হৃদপি- ও চোখ খুলে নিয়ে যায় পাক বাহিনী। স্মৃতিচারণে সহযোদ্ধা গোপাল চক্রবর্তী এমনিভাবে বর্ণনা করছিলেন যুদ্ধে শহীদ হওয়া শ্রীকান্ত দাসকে নিয়ে।
শ্রীকান্ত দান হবিগঞ্জ জেলার আজমীরীগঞ্জ উপজেলাধীন ২নং বদলপুর ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামে ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নীলকান্ত দাস ও মা চন্দ্রময়ী দাসের চার সন্তানের মধ্যে ২য় শ্রীকান্ত।
তাঁর বড় ভাই রতিকান্ত দাস ২০১০ সালে মারা যান। ৩য় ভাই উমাকান্ত দাস ও একমাত্র বোন ময়তারা দাস জীবিত আছেন।
শ্রীকান্ত দাস ১৯৬৯ সালে হবিগঞ্জের বিরাট এবিসি হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ভর্তি হন সিলেট মুরারিচাঁন কলেজে। যথারীতি থাকার জায়গা হল কলেজ ছাত্রাবাসে। কলেজ ছাত্রাবাসে সাক্ষাত মেলে হবিগঞ্জের সন্তান তমাল কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে ছাত্রাবাসের আরেক সহযোগী মনোরঞ্জন দাসের সঙ্গে পরিচয় মেলে। হবিগঞ্জের তিন সহযোগী মিলে প্রায় রাতেই শলা পরামর্শ হতো দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন তমাল কুমার বিশ্বাস।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তাঁরা সবাই উজ্জীবিত হন। উত্তাল মার্চ, ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীরা বাড়ি ফিরতে শুরু করছে। মার্চ মাসের কোন এক তারিখে শ্রীকান্ত দাস এবং মনোরঞ্জন দাস চলে যায়। তাদের দু’জনের বাড়ি পাহাড়পুর গ্রামে। পরবর্তীতে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।
শ্রীকান্ত দাসের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা গোপাল চক্রবর্তী। অশিতিপর বৃদ্ধ গোপাল চক্রবর্তী স্মৃতিচারণে জানান, ১৯৭১ সালের মে মাসে প্রথম সপ্তাহে আমি শ্রীকান্ত, হরিপ্রসন্ন চক্রবর্তী এবং সুশান্ত দাস গ্রামের কুশিয়ারা নদীরপাড়ে বসে ফুটবল খেলা দেখেছিলাম। তখন দেখি পাক বাহিনীর একটি গানবোট নদী দিয়ে যাচ্ছে আর নদীর দু’পাড় লক্ষ করে গুলি ছুড়ছে। তাৎক্ষণিক খেলা বন্ধ করে সবাই দিকবিদিক ছুটাছুটি করে গ্রামের ভেতর চলে যায়।
রাতে আমি, শ্রীকান্ত, হরিপ্রসন্ন এবং সুশান্ত মিলে শলাপরামর্শ করি। শ্রীকান্ত ভরাক্ষান্ত মন নিয়ে বলে দাদা এভাবে চলা যায় না। চলেন আমরা যুদ্ধে চলে যাই। পরিবারে যুদ্ধে যাবার কথা বললে অনুমতি মিলবে না, ফলে আমরা চার জনই পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেই।
১৯৭১ সালের ১৭ মে আমি গোপাল চক্রবর্তী, শ্রীকান্ত দাস, হরিপ্রসন্ন চক্রবর্তী এবং সুশান্ত দাস চার জন রাতের আঁধারে পাহাড়পুর থেকে ভারতের বালাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ভারতের মেঘালয় এ.কিউ ওয়ান মুক্তিযোদ্ধ প্রশিক্ষণ শিবিরে ২৮ দিন আমরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণ শেষে ৫নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মীর শওকত আলী, সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ মোতালিব এর অধীনে কোম্পানী এনামুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে সরাসরি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি। কোম্পানীর সেকেন্ড কমান্ডার ছিলেন মো. সিরাজ মিয়া। অদম্য সাহসী শ্রীকান্ত দাসের প্রবল মনের জোর থাকায় রণ কোশলে অসম্ভব মেধা থাকায় তাঁকে গ্রুপ লিডার করে দেয়া হয়। ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী শ্রীকান্ত বিজ্ঞানের ছাত্র থাকায় সহজেই অস্ত্র চালানো রপ্ত করে।
গোপাল চক্রর্তী স্মৃতিচারণে আরও জানান, আমাদের কোম্পানীর সেকেন্ড কমান্ডার মো. সিরাজ মিয়ার কমান্ডে আমি, শ্রীকান্ত, হরিপসন্ন চক্রবর্তী এবং সুশান্ত দাসসহ প্রায় ২০-২৫ জন যোদ্ধার উপর দায়িত্ব পড়ে বৈশেরপাড় অবস্থান নিয়ে শত্রুপক্ষের উপর হামলা করা। হানাদার বাহিনীর অবস্থান ছিল বৈশেরপাড়া এলাকায়। ২৭ নভেম্বর তারিখে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। আমাদেরর রসদ গুলাবারুদ শত্রুপক্ষের চেয়ে অনেক কম ছিল এমনকি জনবলের দিক থেকেও আমরা অনেক দুর্বল ছিলাম। প্রচন্ড গুলাগুলির মধ্যে শ্রীকান্ত এক পর্যায়ে অনেক সম্মুখে চলে যায়। ষোলঘর এলাকায় ক্রলিরত অবস্থায় হানাদার বাহিনীর গুলি শ্রীকান্তের শরীরে পড়ে শরীর ঝাঝড়া হয়ে পড়ে। হানাদার বাহিনী কাছাকাছি চলে আসায় আমরা কিছু হটতে বাধ্য হই। শ্রীকান্তের লাশ তাৎক্ষণিকভাবে আমরা নিয়ে আসতে পারিনি। রাস্তায় পড়েছিল তাঁর লাশ। বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে শ্রীকান্তের দেহ থেকে হৃদপি- ও চোখ খুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। তাদের ধারনা ছিল শ্রীকান্ত হয়ত বংলাদেশের বড় মাত্রার কোনো কর্মকর্তাপ। যার ফলে পাক বাহিনী বৈশেরপাড় যুদ্ধের পর উল্লাস করতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে সে যুদ্ধে আমরা পাক বাহিনীর কাছ থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাদের লোকবল এবং গুলাবারুদের নিকট আমরা পরাস্থ হয়েছিলাম। বৈশেরপাড় যুদ্ধে আমরা বেঁচে গেলেও আমাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধু শ্রীকান্তকে বাঁচাতে পারিনি। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় শ্রীকান্তকে জয় বাংলা বাজার সংলগ্ন গণকবরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ডলুরা গণকবরে ৪৪নং স্মৃতিস্মারকটি শহীদ শ্রীকান্ত দাসের। যুদ্ধের কিছু দিন পর দেশ স্বাধীন হলে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মীর শওকত আলী বলেছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সুপারিচিত করা হবে যাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ খেতাব শহীদ শ্রীকান্ত দাসকে দেয়া হয়।
গোপাল চক্রবর্তী আক্ষেপ করে বলেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক বীরশ্রেষ্ঠ দূরে থাক, বীরউত্তম, বীরবীক্রম এমনকি বীরপ্রতীক পদকও দেয়া হয়নি শ্রীকান্ত দাসকে।
যুদ্ধে শহীদ হওয়া শ্রীকান্ত দাসের ভাই উমাকান্ত দাস জানান, যুদ্ধের পর আমরা শুধু জানতে পেরেছি আমাদের ভাই বৈশেরপাড় শহীদ হয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধের পর আমার ভাইকে রাষ্ট্রীয় কোনো পদক দেয়া হয়। তিনি আরো জানান, আমরা শহীদ পরিবার অথচ রাষ্ট্রীয় কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি। অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছি। তবে আমার বড় ভাইকে মানুষ স্মরণ করছে এটাই বড় পাওয়া। আমরা শহীদ পরিবার এ কারণে অনেক গর্ববোধ করি।

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!