হাওরের ফসল বাঁচানোর বাঁধরক্ষার যুদ্ধে বিরতি দিয়ে এখন ধান কেটে তোলার যুদ্ধে নেমেছেন হাওরের চাষীরা। গত ১৮ দিন ধরে প্রশাসনের ডাকে স্বেচ্ছাশ্রমসহ শ্রমিক হিসেবে বাঁধরক্ষার কাজ করেছেন তারা। অস্থায়ী মাটির বাঁধগুলো পাহাড়ি ঢলে একটি একটি করে দেবে, ভেঙ্গে ও উপচে হাওরে পানি প্রবেশ করে শ্রমঘামে ফলানো একমাত্র ফসল তলিয়ে নিচ্ছে। একদিনেই (রবিবার) তিনটি বাধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে বহু ফসল। এই দৃশ্য দেখে এবার অন্যান্য এলাকার কৃষকরা বাধ ফেলে নতুন করে ধান কাটার যুদ্ধে নেমেছেন। হাওরের নিয়তিবাদী চাষীরা হারতে চাননা, তাই রুদ্র প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেও ক্লান্ত না হয়ে ধান কাটা যুদ্ধে নেমে খোরাকি সংগ্রহের চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে তাদের।
সরেজমিন সোমবার তিনটি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত দেখার হাওর ও দুটি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত খরচার হাওর ঘুরে দেখা গেছে হাওরে হাজার কৃষক ধান কাটছেন। তারা ধানকাটা হাওরের পাশে তৈরি ধান রাখা, শুকানো ও বিশ্রামের জন্য নির্মিত খলায় নিয়ে এসেছেন স্ত্রী, কন্যা ও স্কুল শিক্ষার্থীদেরও। আকাশে মেঘের দৌড়াদৌড়ি, বজ্র বিদ্যুতের চোখরাঙানিকে থোরাই করছেন হাওরের সংগ্রামী কৃষক। যন্ত্রে, কাস্তে ধান কাটছেন সমানে। সেই ধান সামলাচ্ছেন নারী কিষানীরা।
সোমবার সকালে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরে গিয়ে দেখা যায় মুক্তিখলা গ্রামের কৃষক আব্দুল মালিক বেশি শ্রমিক না পেয়ে ২-৩জন নিয়ে ধান কাটছেন। তিনি ও দুই শ্রমিক ধান কাটছেন আর তার দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে রুবিনা আক্তার ধানের মুঠো হাওরের জাঙ্গালে নিয়ে রাখছে। দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া এক নাতনিকেও ধানের আটি টানতে দেখা যায়।
কৃষক আব্দুল মালিক বলেন, দিনমাদান বালানা। গাঙোও ফুলতেছে। বান্দ বাঙ্গে বাঙ্গে অবস্থা। অখন বান্দের আশা বাদ দিয়া আউরো ফায়ফুরুতা লইয়া নামছি। ৫ কেয়ার ধান লাগাইছি। ই ধান পাইন্যে নিলেগি না খাইয়া থাকতো অইব। তাই খাচামাছা খাইট্যা তুলতাছি। (সময় ভালো না। নদী ফুলে ওঠছে। বাধ ভাঙ্গে ভাঙ্গে অবস্থা। এখন বাধের আশা বাদ দিয়ে হাওরে সন্তান সন্তুতি নিয়ে নেমেছি। দেড়শ শতক জমিতে ধান লাগিয়েছি। এই ধান পানিতে তলিয়ে গেলে না খেয়ে থাকতে হবে। তাই কাছাপাকা ধান কেটে তুলছি)।
একই হাওরে মুক্তিখলা গ্রামের কিষাণী কোকিলা বেগম ধানখলায় ধান নাড়ছিলেন। তার স্বামী সন্তান শ্রমিক নিয়ে হাওরে ধান কাটছেন। ধান মেশিনে ভাঙ্গানো শেষে খলায় কিছুটা শুকানোর জন্য নাড়ছিলেন ধান। তার সপ্তম শ্রেণি পড়–য়া মেয়ে তানিয়া বেগমও মায়ের সঙ্গে খলায় কাজ করছিল। কোকিলা বেগম বলেন, ‘অতদিন হকলে বান্দো কাম করছে। অনে আউরোর পানির ঠেলা দেইখ্যা হকলে বান্দ ছাইড়া আউরো আইছইন। আমরাও আইছি। ধান পাইন্যে নিলেগিতো সব শেষ। (এতদিন সবাই বাঁধে কাজ করছে। এখন হাওরের পানির চাপ দেখে সবাই বান্দ ছাইড়া হাওরে এসেছেন। আমরাও এসেছি। ধান পানিতে নিলে সব শেষ)।
সোমবার দুপুরে দেখার হাওরে গিয়ে দেখা যায় শাফেলা গ্রামের কৃষক নূর হোসেনকে দেখার হাওরে বর্গাচাষের জমিতে ধান কাটতে। নূর হোসেন বলেন, গত কয়েকদিন খরচার হাওরের বিভিন্ন ঝূকিপূর্ণ বাধে কাজ করেছি। এখন চারদিকে হাওরের বাধ ভেঙ্গে ফসল তলিয়ে যাওয়া দেখে নিজের ক্ষেতের ধান কাটতে এসেছি। বছর ভালো হলে হয়তো আরো কয়েকদিন পরে ধান কাটতাম। কিন্তু দ্রুত পানি বাড়ার কারণে ধান কাটতে নেমেছি। পানি আসতে আসতে যাই কাটতে পারি তাই ভালো।
এদিকে রবিবার রাতে দিরাই উপজেলার হোরামন্দিরা হাওরের ৪২ নম্বর প্রকল্পের বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি ডুকতে শুরু করে। সকালেই সাদা হয়ে যায় হাওরটি। বাঁধ এলাকা থেকে লোকালয় দূরে থাকায় রাতে বাধে পানি আটকানোর চেষ্টা করতে পারেননি কৃষকরা। তবে গত ১৫ দিন ধরে তারা এই হাওরের বিভিন্ন পয়েন্টে কাজ করেছেন।
হাওরের কৃষক বশির মিয়া বলেন, বান্দো অতদিন কাজ করছি। গেছে খাইল থেকে কাম বাদ দিছি। এর মাঝে রাইতে বান্দ ভাইঙ্গা আউর নিছেগি। গেছে খাইল আর আইজ এক কিয়ার জমিনের ধান কাটতাম পারছি। বাকি ধান সব তলাইয়া গেছে। (বাধে এতদিন কাজ করছি। গতকাল কাজ বাদ দিয়েছি। এর মধ্যে রাতে বাধ ভেঙ্গে হাওর নিয়েছে। গতকাল আর আজ ৩০ শতাংশ জমির ধান কাটতে পেরেছি। বাকি ধান তলাইয়া গেছে।
এভাবে বিভিন্ন এলাকায় হাওরের বাধ ভেঙ্গে যাওয়ার দৃশ্য দেখে কৃষকরা ধান কাটার যুদ্ধে নেমে পড়েছেন। হাওরে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন স্ত্রী, কন্যা ও স্কুল পড়–য়া সন্তানদেরও।
ধর্মপাশা উপজেলার বংশিকু-া দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাসেল আহমদ বলেন, গত ১ এপ্রিল থেকে আমরা স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে বাঁধগুলোতে কাজ করছি। এখনো আমাদের অবশিষ্ট বাঁধগুলো খুবই ঝূকিতে। তবে গত দুই দিন থেকে ঝূকিপূর্ণ বাঁধ গুলোতে কাজ করার জন্য কোন শ্রমিক মিলছেনা। তারা সবাই বাধ বাচানোর আশা ছেড়ে দিয়ে এখন হাওরে নেমে পড়েছেন। যতটুকু ধান কাটতে পারেন সেই চেষ্টাই করছেন।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক ও জেলা বাঁধ রক্ষা ব্যবস্থাপনা ও তদারকি কমিটির সদস্য মো. জাকির হোসেন বলেন, আমরা গত বিশ দিন ধরে বাধগুলোতে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কর্মকর্তাবৃন্দ রাতদিন স্থানীয়দের নিয়ে কাজ করেছেন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু হঠাৎ অস্বাভাবিক পানির চাপ বাধগুলো নিতে পারছেনা। তাই বিভিন্ন স্থানে বাধ ভাংছে। এখন বাধে কাজ করবো এমন লোকও পাচ্ছিনা। তাই এলাকার মানুষ ফসলের মায়ায় বাধ রেখে এখন হাওরে নেমেছেন। তারা ধান কেটে তোলার চেষ্টা করছেন। আমরা একই সঙ্গে বাঁধ রক্ষা ও ধান কাটার কাজ তদারকি করছি।
এদিকে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে সোমবার পর্যন্ত জেলায় ৬১ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে। যদিও এই তথ্য নিয়ে কৃষক ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্ন আছে।