গোলাম সরোয়ার লিটন, তাহিরপুর
প্রধানমন্ত্রী হাওরাঞ্চলে ধান কাটার জন্য ৭০ ভাগ ভুর্তুকিতে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার পাঠিয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসনও দ্রুতই এ যন্ত্র হাওরপাড়ের কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। এতে করে কৃষকরা কম খরচে দ্রুত ধান কেটে গোলায় তুলতে পারছেন। ধানকাটার যন্ত্র দিয়ে ধান কাটলে শীষ থেকে ধান জমিতে পড়েনা এবং পরিবহনেও ধান ক্ষতিগ্রস্থ হয়না। এতে করে লাভবান হাওরের কৃষক। হাওরে রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ , ধানের বাম্পার ফলন আর ধান কর্তনে সুবিধা থাকায় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার কৃষকের মুখে হাসি আর গান।
উজান তাহিরপুর গ্রামের কৃষক আর্শাদ আলী জানান, আজ শনির হাওরের ৫ কিয়ার (১ কিয়ার=৩০ শতক) জমির ব্রি-২৮ ধান কম্পাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে কর্তন করেছেন দুই ঘন্টায়। এ যন্ত্রে ধান কাটলে একই সাথে মাড়াই হয়ে জমির ধান বস্তাবন্দী হয়ে যায়। এতে তার মোট খরচ হয়েছে ১২শত টাকা কিয়ার হিসাবে মোট ৬ হাজার টাকা। তিনি যদি শ্রমিক দিয়ে একই কাজটি করেন তবে তার খরচ পড়বে ১৬ হাজার টাকা। নিজের পরিশ্রমও অনেকগুণ বেড়ে যাবে। আর সময় লাগবে মোট দুই দিন। এজন্য তিনি হিসাব দিয়েছেন- ধান কাটার জন্য ২০ জন শ্রমিক কে একদিন কাজ করতে হবে। কৃষি শ্রমিকের একদিনের কাজ বলতে সাধারণত ৮ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টা সময়কে বুঝানো হয়। এজন্য খরচ পড়বে (প্রতি কিয়ার কর্তনে কমপক্ষে ২ হাজার টাকা) মোট ১০ হাজার টাকা। এই জমির কাটা ধানের মুটি পরিবহনে খরচ হবে (প্রতি কিয়ার এক হাজার টাকা) ৫ হাজার টাকা। আর মাড়াইয়ের জন্য খরচ পড়বে (প্রতি কিয়ার ৩শত) ১৫শত টাকা । আর এজন্য সময় লাগবে দুই দিন। তাছাড়া হাতে ধানকাটা হলে আর মাথায় করে ধান মাড়াই খলা পর্যন্ত পরিবহন করলে মুটিতে থাকা ধানের শীষ থেকে ধান কিছুটা হলেও ঝরে পড়ে। এভাবে ধান ঝরে পড়ার হার প্রতি কিয়ারে প্রায় এক মন থেকে দুই মন । কিন্তু কম¦াইন্ড হার্ভেস্টারে ধান কর্তনে ধান ঝরে পড়ারও কোন সুযোগ থাকেনা। তাই নানাবিধ কারণে হাওরাঞ্চলের কৃষকের কাছে এই কম্পাইন্ড হাভেস্টার বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে । একই কারণে অন্য বছরের তুলনায় এ বছর ধানকাটা শ্রমিকের কদর কমেছে, কমেছে মুজুরীও।
কৃষক ইয়াসির আরাফাত বলেন, শনির হাওরে রোপিত জমির ধান পেকেছে। চেষ্টা করছি ধানকাটার যন্ত্র দিয়ে কাটতে। যদি না পাই তবে বাধ্য হব কৃষি শ্রমিক দিয়ে ধান কাটাতে।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় জানায়, উপজেলায় এ বছর ১৭ হাজার ৫শত ২৭ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৯৭ হাজার ৪শত ৫৮ মেট্রিক টন। এ পর্যন্ত ৬৫ ভাগ জমির ধান কাটা হয়েছে। হাওরে ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় আর আবহাওয়া অনুকুল থাকায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশাবাদ।
তবে কৃষকরা বলছেন এখন পর্যন্ত হাওরে ৮ হাজার হেক্টর জমির ধান কর্তনের বাকী আছে। এর মধ্যে স্থানীয় জাতের দেশি ধান কর্তন বাকী আছে আড়াই হাজার হেক্টর। এছাড়াও ব্রি-২৯ ধান ও এ ধরণের দেরিতে পাকে এমন ধান কর্তনের বাকী আছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর।
কনির হাওরপাড়ের কৃষক ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হাফিজ উদ্দিন বলেন, আমাদের হিসাবে হাওরে দেশি জাতের ও ব্রি-২৯ প্রজাতির ধানসহ ৮ হাজার হেক্টর ধান কর্তনের বাকী আছে।
মাটিয়ান হাওরের কৃষক তাহিরপুরের টানা তিনবারের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল তালুকদার বলেন, এ বছরে হাওরে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। ধানকাটায়ও সুবিধেজনক অবস্থায় আছেন কৃষক। মেশিন এ সুবিধা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
উপজেলা উপসহাকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান জানান, ধান কর্তনের জন্য উপজেলায় এ বছর ১৩টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার হাওরের জমিতে ধান কর্তন করছে। এর মধ্যে ৫টি শনির হাওরে, ৪টি মাটিয়ান হাওরে ধান কর্তন করছে। প্রতিটি হার্ভেস্টার যন্ত্র ঘন্টায় আড়াই কিয়ার (৯০শতক) জমির ধান কাটতে পারে। একই সাথে এবং একই সময়ে ধান মাড়াই ঝাড়া ও বস্তা ভর্তি হয়ে যায়। কম খরচে দ্রুত সময়ে ধানকাটা, মাড়াই ও বস্তাভর্তি হয়ে যায় বলে এ যন্ত্রটি কৃষকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
দলবল নিয়ে শনির হাওরে ধানকাটছেন এমন একটি শ্রমিক দলের সর্দার রহমত আলী (৫০)। তিনি উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের শিমুলতলা গ্রামের বাসিন্দা। প্রতি বছরের মতো এ বছরও ধান কাটতে তিনি হাওরে এসেছেন। এ বছর তার দলের কৃষিশ্রমিক ২১ জন। অস্থায়ী উড়া (ঘর) করে সবাইকে নিয়ে আছেন শনির হাওরের উত্তর পাড়ে উপজেলা পরিষদের নিকটবর্তী একটি মাড়াই খলায়। তিনি জানান, ১২ জন শ্রমিক নিয়ে আসার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু করোনারা কারণে কাজ না থাকায় আরো ৯ জন অতিরিক্ত শ্রমিক সাথে করে নিয়ে আসতে হয়েছে। তিনি জানান, অন্য বছর কৃষকরা জমির ধানকাটাতে তাদের অস্থায়ী বাসস্থানে এসে খাতির জমাতে ভীড় করতো। তাদের অনেকেই নানাভাবে আপ্যায়নের চেষ্টা করতো। কিন্তু এ বছর উল্টো হচ্ছে। কম টাকায় কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন। তবুও ধানকাটতে কৃষকের জমি পাচ্ছেন না। কৃষকরা মেশিন দিয়ে ধানকাটার সুযোগ পেলে আর তাদের কাছে আসেন না বলে জানান, রহমত আলী।
৭০ ভাগ ভূর্তুকিতে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার কিনেছেন উপজেলার সদর ইউনিয়নের উজান তাহিরপুর গ্রামের কৃষক মঙ্গনুল হক। তার কেন ধান কাটা মাড়াইয়ের এ যন্ত্রটি শনির হাওরের কৃষকের ধান কেটে চলেছে। আজ তার যন্ত্র দিয়ে শনির হাওরের এর্শাদ মিয়া, ইয়াকুব আলী, জমির হোসেন ও আফিজ আলীর ২০ কিয়ার জমির ধানকাটা, ঝাড়াই ও বস্তাভর্তি করে সম্পন্ন করেছেন। তিনি জানান, লোকজন প্রথম তাদের কাছেই আসে যন্ত্রে দিয়ে ধান কাটাতে। যদি সিরিয়াল না পায় তবেই কৃষি শ্রমিকের কাছে যায়।
কৃষক আফিজ আলী বলেন, দুই দিনের কাজ দুই ঘন্টায় হয়। যেখানে অর্থ আর সময় দুটোই সাশ্রয়ী। সঙ্গতকারণেই কৃষকের দীর্ঘদিনের সাথী কৃষিশ্রমিক ছেড়ে যন্ত্র এখন প্রিয় হয়ে ওঠেছে।
কৃষক তানজিম হাসান বলেন, এ বছর ধান কাটায় শ্রমিক বেশি এসেছে রয়েছে ধানকাটার যন্ত্রও রয়েছে। অন্য বছর কৃষকদের কৃষকদের জিম্মি করে (তার ভাষায় পাওয়ার ফুল) তারা টাকা আদায় করে ধান কাটত । এ বছর ধানকাটা নিয়ে কৃষকদের সেই দিন বা দুঃশ্চিন্তা নেই।
মাটিয়ান হাওরপাড়ের বড়দল গ্রামের কৃষক সামায়ুন মিয়া বলেন, হাওরের রৌদ্রজ্জ্বল দিন, ধানের বাম্পার ফলন এবং অর্থ ও সময় সাশ্রয়ী হার্ভেস্টার যন্ত্র হাওরের কৃষকের মুখে দিয়েছে হাসি আর গান। কারণ ধান তুললেই আমরা ধনী।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসান-উদ-দৌলা বলেন, আমরা চেষ্টা করছি হাওর থেকে উৎপাদিত বছরের একমাত্র ফসল সহজেই তাঁদের গোলায় তুলতে পারেন।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজেন ব্যানার্জী বলেন, করোনা দুর্যোগেরও মধ্যেই হাওরে উৎসবের মধ্যে দিয়ে ধানকাটা চলছে। হাওরে ধানের বাম্পার ফলন আর ধানকাটায় সংকট না থাকায় হাওরাঞ্চলের কৃষকের মুখে হাসি।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, কৃষকের মুখে হাসি আর গান ছড়িয়ে দিতে আমরা সবধরণের চেষ্টাই করছি। এজন্য করোন দুর্যোগেও কৃষকের পাশে থাকতে প্রতিদিন হাওর আর মাড়াই খলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি।